মেয়ে- চুল কাটো, শার্ট পরো, রক্ষা পাবে তবে!

জয়নাল আবেদীন
Published : 16 Feb 2016, 09:01 PM
Updated : 16 Feb 2016, 09:01 PM
একটা সময় এই দেশে ১০-১২ বছর বয়সী মেয়ে শিশুর বিয়ে নিয়ে আওয়াজই ছিল না। এখন ১৬ বছরের কিশোরীর বিয়ে নিয়েও অনেক কথা। কালের পরিক্রমায় এই পরিবর্তনটা নিঃসন্দেহে যথোপযুক্ত।
মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ বছর- এটা আইনসিদ্ধ। সাধারণত একটা মেয়ে এসএসসির গণ্ডি পেরোতেই তার বিয়ের তড়িগড়ি শুরু হয়। এটা কিন্তু মেয়েদের দোষ না। মেয়েটিকে বিয়ে করি আমরা ছেলেরাই। আর ওকে বিয়ে দেওয়ার আয়োজনে যারা থাকি, তারাও পুরুষ।
আমি বরাবরই সমাজবিরোধী। কোনো অস্বচ্ছল পরিবারের ছেলে-মেয়ের বিয়েতে সহায়ক ভূমিকা রাখলে সমাজকে বাহবা দেওয়া যায়। সমাজকেই যদি বিয়ে বাবদ চাঁদা দিতে হয়, তাহলে সেই সমাজকে দুয়ো দেবেন না?
এই সমাজের অনেক 'নিয়মের' শৃঙ্খলে আমরা বন্দি। একটা মেয়ে এসএসসি পাশ করেছে। বিয়ে দিয়ে দাও। চোখ-কান খুলে গেছে। বিয়ে দিয়ে দাও। কলেজে বহু ছেলের সঙ্গে লাইন মারছে। বিয়ে দিয়ে দাও। সমাজ বোঝেই শুধু বিয়ে। সেটা তো বুঝবেই। বিয়ে মানেই তো চাঁদা!
সমাজের এই অনিয়মের বলয় আমাদের এতখানিই গ্রাস করেছে যে, আমরা কোন ফাঁকে নিজেদের সর্বনাশ করি, তা নিজেরাই টের পাই না। সেসব বিশৃঙ্খলের কাছে আমরা তখন অন্ধ হয়ে পড়ি!
ঘরের মেয়েটির ভবিষ্যত নির্ভর করে বাবা কিংবা বড় ভাইয়ের ওপর। বাবারা মেয়েদের নিয়ে কতটা দুশ্চিন্তায় থাকেন, সেটা দেখেছি আমার বাবার মধ্যে। যৌতুকের টাকা আগে থেকেই 'ফিক্সড ডিপোজিট' করে রেখেছিলেন ১১টি বৃক্ষরোপন করে।
ফারজানা নামের মেয়েটির গল্প কোনমতেই পিছু ছাড়ে না। ওর কাহিনি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বহু মত। কিন্তু যখনই মেয়েটির আর্তনাদ শুনি, ভেতরে জমিয়ে রাখা অভিযোগ-অনুযোগ শুনি; তখন আবার কোমরবেঁধে নেমে যেতে ইচ্ছে করে। মন চায়, খুঁড়ে আনি পেছনের গল্প; যা আজো কেউই জানে না।
ফারজানা যখন এসএসসি পাশ করেছিল, তখনই ওর দিকে চোখ যায় অনেকের। গ্রামে যারা বসবাস করেন বা করেছেন, তাদেরকে বিষয়টির ব্যাখ্যা না দিলেও বুঝবেন। ও এইচএসসি পাশ না করতেই বাবা টেনশনে পড়ে গেলেন! মেয়ে তো চঞ্চলা। যদি কিছু করে বসে?
এর মধ্যে বহু ঘটকের ভিড়ও ছিল। ঘটকদের কাজও তো সেটা। কার ঘরে কটা মেয়ে আছে, সেটা লিপিবদ্ধ করে রাখা। কোনো ঘটকের নোটবুকে ফারজানার নামটিও হয়তো ছিল। বর ঠিক হলো।
মেয়ের বাবা যেন বেঁচে গেলেন! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। যাক, কোন অঘটনের আগেই মেয়েকে পার করে দিতে পেরেছি! বিয়ে নিয়ে মেয়ের আপত্তি শুনেছিলেন কেউ? সে আরো পড়তে চেয়েছিল। সেটা শুনে হবু বর প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, আমি বেঁচে থাকতে তোমার পড়াশোনা বন্ধ হবে না।
বাবার দিকে চেয়ে আর হবু বরের প্রতিশ্রুতি শুনে মেয়েটি আর বাধা দিল না। বিয়ে হলো ধুমধাম করে। কদিন পরই ওর পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে চাইল বর কিংবা বরপক্ষ। এই তো ‍শুরু।
ফারজানাকে বিয়ের পর বরপক্ষ থেকে নির্যাতন করা হয়েছে- এই অভিযোগের পক্ষে-বিপক্ষে বহু মত আছে। কিন্তু ফারজানা জোর গলায় বলছেন- 'একজন নারী মিথ্যা বলতে পারেন, একজন মা কখনো মিথ্যা বলতে পারেন না।'
তিনি আরো বলেন- 'আমার পাশে কেউই নেই। বড় ভাই নেই, বাবা থেকেও নেই।'
কী ভাবছেন? একটা মেয়ে কতটা বখে গেলে বাবা থেকেও নেই বলতে পারে? এই মেয়ের অভিযোগের ভিত্তি কতটুকু?
আমি খোঁজ নিয়েছি। পুরো ঘটনাটি পর্যবেক্ষণ করেছি। আমার দৃষ্টিতে সমস্ত ঘটনায় এক নাম্বার আসামি ফারজানার বাবা! এরপর ফারজানা নিজে এবং তার স্বামী।
তার বাবাকে এ কারণেই এক নাম্বার আসামি বলছি- তিনি যদি ঘুণে ধরা সমাজের দিকে না চেয়ে মেয়ের ইচ্ছার মূল্য দিতেন, তাহলে হয়তো আজকের দিনে তার কলিজার টুকরো মেয়েটির মাথায় ঝুলত না তালাকনামা! তার কোলে থাকতো না এক প্রতিবন্ধী শিশু।
এই প্রতিবন্ধী শিশুটিকে ঘিরেই যত কাণ্ড! জানি না, ফারজানার মেয়েটি প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ার নেপথ্যে কত বড় জঘণ্য ঘটনা লুকিয়ে আছে? স্বামী নিজেকে ধোয়া তুলসী পাতা দাবি করছেন। এমনকি ফারাজানার বাবারও কোনো অভিযোগ নেই।
অথচ ফারজানা বলছেন- 'শ্বাশুড়ি এবং এক জা আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় আমার পেটে লাথি মেরেছিল। পুরো একদিন পেটের ভেতরে নবজাতকের কোনো স্পন্দন ছিল না। এখনো তলপেটে ব্যাথা করে।'
এসব কথা ফারাজানার বাবাও আমলে নিচ্ছেন না! আমার যতটুকু পর্যবেক্ষণ, নানা কারণে মেয়ের ওপর ক্ষোভ এবং দূরত্বের কারণেই বাবার কানে প্রকৃত ঘটনা পৌঁছায়নি। কিংবা মেয়ের কোনো আরজি গুরুত্বই দিচ্ছেন না বাবা। আর এই সুযোগে সত্যিকারের কোনো অপরাধী পার পেয়ে যাচ্ছে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে বিষয়টা দাঁড়ায় এ রকম-
এইচএসসি পাশের পর ফারজানা উচ্চ শিক্ষা লাভ করতে চেয়েছিল। কিন্তু চঞ্চল মেয়েটি বাবার মুখে চুনকালি মেখে দেবে- এমন আশংকায় মেয়ের আপত্তি সত্ত্বেও তাকে বিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ে হয় তার প্রায় দ্বিগুণ বয়সী একটি ছেলের সঙ্গে। বয়সের দূরত্বটা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নানা রকমের বিভেদ তৈরি করে। বিভেদের সূত্র ধরে নির্যাতন। তারই ফলশ্রুতিতে তাদের মেয়ে সাইফার অস্বাভাবিক অবস্থা। সর্বশেষ প্রতিবন্ধী মেয়ে জন্ম দেওয়ার অপরাধে বিবাহ বিচ্ছেদ।
সাইফাকে তার বাবার কাছে হস্তান্তর না করায় ফারজানাকে তার বাবা যতই গালমন্দ করুন না কেন, মায়ের মমতা বলতে একটা বিষয় আছে, সেটা একবার হলেও চিন্তা করতে হবে। ফারজানার স্বামী নিজেকে এতটাই ধোয়া তুলসি দাবি করতে পারেন। অথচ প্রতিবন্ধী মেয়েটির চিকিৎসার খরচ দিচ্ছেন না। যে পুরুষ তার মেয়েকে ভালোবাসে না, কী করে স্ত্রীকে ভালোবাসবেন তিনি?

করেরহাটের ফারজানা আক্তারের বিয়ের আগে-পরের গল্পগুলো এই সমাজের হাজার বছরের 'শৃঙ্খল' ভেঙে দিতে পারে। আমাদের দেশে এমন ঘটনা অহরহই ঘটছে। কিন্তু ফারজানার জীবনের এই গল্পটি সব বাবাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, মেয়ের চোখ-কান খুললে বিয়ে নিয়ে তাড়াহুড়া করতে নেই। বিয়েটাই একমাত্র সমাধান নয়।

একটা বিষয় কি খেয়াল করেছেন? এ দেশে বখে যাওয়া শ্রেণির তালিকায় মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের সংখ্যা অনেক বেশি। আপনার গ্রামের কিংবা পাশের গ্রামের বহু মেয়ে কলেজে যাওয়ার নামে প্রেমিকের হাত ধরে ডেটিংয়ে যায়- এ কথা সত্য। কিন্তু কটা মেয়ে দিন-রাত সিগারেটের ধোঁয়া উড়ায়? কটা মেয়ে ইয়াবা নেয়? ফেনসিডিল, গাঁজা কিংবা মদ হাতে নেয় কটা মেয়ে?
ওই মেয়েটির হাত ধরে ডেটিংয়ে নিয়ে যাওয়া ছেলেটিকে নিয়ে কেন এত কথা ওঠে না? সে তো সিগারেটের ধোঁয়া উড়ায়। মাঝে মাঝে ইয়াবা খায়। ফেনসিডিল, গাঁজা কিংবা মদের বোতলও হাতে নেয়!
এই ছেলের বয়স পঁচিশ পার হয়। যথেষ্ঠ পরিমাণে বখে যায়। কোনো বাবা কী এমন বখে যাওয়া ছেলেটিকে শোধরানোর জন্য বিয়ের পথ খোঁজেন? আমার উত্তর- না। অথচ মেয়ে নিয়ে কত টেনশন! বাবাদের এত টেনশন যদি মেয়েদের থেকে ছেলেদের নিয়ে বেশি হতো, তবে কতই না ভালো হতো। সমাধানের বড় অংশটি সেখানেই।
আচ্ছা, ছেলে আর মেয়ের মধ্যে কেন এত ভিন্নতা খুঁজি আমরা?
মেয়েদের চুল লম্বা হয়, ছেলেদের ছোট। মেয়েরা সালোয়ার-কামিজ পরে, আমরা পরি প্যান্ট-শার্ট। ছেলে-মেয়ে ব্যবধানটা বোঝার জন্য এর বাইরে আর কিছু গুরুত্ব দিব কেন?
বখাটে শব্দের বিশ্লেষণে মেয়ে-ছেলে বলতে কিছু নেই। তাহলে আমরা কেন আলাদা করে দেখি? এটা প্রতিরোধের জন্য সবার ক্ষেত্রে সমান সমাধানই তো কাম্য। অথচ বাবাদের নানা আশংকায় আজ মেয়েরাই পিষ্ট!
নাকি সমাজ নামের বিশৃঙ্খলকে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য মেয়েদেরও ছেলে হয়ে যেতে বলবো? ফারজানারা তাতে যদি সুখী হয়, তবে আমার তরফ থেকে প্রেসক্রিপশন এটাই। মেয়ে- তুমি চুল কাটো, শার্ট পরো; রক্ষা পাবে তবে।
>> লেখক : সাংবাদিক, news.joynal@gmail.com
https://www.facebook.com/muhammed.abedin