মন্ত্রীর ফাঁকাবুলি!

জয়নাল আবেদীন
Published : 18 Feb 2016, 02:34 AM
Updated : 18 Feb 2016, 02:34 AM

একসময় দুই লেনের সড়কে সরু ব্রিজ অতিক্রম করতে গিয়ে দুটো গাড়ি পাশাপাশি চলাচল করতে পারত না। সাপের মতো আঁকাবাঁকা সড়ক ছিল বহু পুরনো বাজার ঘেঁষা। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাতায়াত তখন ছিল পুরো দিনের কারবার। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসার নিয়ত করলে নির্ধারিত কর্মপরিকল্পনার একদিন আগেই রওনা দিতে হত।

কর্ণফুলীর তীরে অবস্থিত চট্টগ্রাম শহরের গুরুত্ব হঠাৎ কোনো কারণে নয়। সাগরপথে আন্তর্জাতিক পণ্য আমদানি-রপ্তানির কেন্দ্রস্থল হওয়ায় এই শহর সোনায় সোহাগা। বন্দরনগরীকে বাণিজ্যিক রাজধানী নামেও ডাকা হয়।

বিশ্ব অর্থনীতিতে এখন বাংলাদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট পয়েন্ট। সেইদিন হয়তো খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন চীন থেকে মিয়ানমার হয়ে ভারত-নেপাল-ভুটানকে একসুতোয় গেঁথে রাখবে বাংলাদেশই। এই সবুজ দেশটিই হবে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের প্রাণকেন্দ্র।

দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থেকেই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পরিসর বাড়ানোর স্বপ্ন দেখেছিল সরকার। ২০০৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর চার লেন প্রকল্পের অনুমোদন হয়। বাণিজ্যিক রাজধানীর সঙ্গে যোগসূত্র গতিশীল করতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন করার সিদ্ধান্ত শুনে কে না খুশি হয়েছে।

কথা ছিল, ২০০৬ থেকে কাজ শুরু হয়ে ২০১২ সালের জুনেই আলোর মুখ দেখবে চার লেন প্রকল্প। গল্প এখানেই শেষ নয়। গুরুত্ব বিবেচনায় বর্তমান মহাজোট সরকার এটিকে মেগা প্রকল্পের মর্যাদা দেয়। ছয় বছর তো কবেই কেটে গেলো, ১১ বছরেও শেষ হলো না কাজ! এখন আবারও বাড়লো মেয়াদ! বাড়লো ব্যয়!

গতকাল মঙ্গলবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) একনেক সভায় ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। নতুন মেয়াদ অনুযায়ী এই প্রকল্পের কাজের সময়সীমা ধরা হলো চলতি বছরের ডিসেম্বর। আর ব্যয় হবে প্রায় তিন হাজার ৮১৭ কোটি টাকা।

বারবার সময়-ব্যয় বাড়ানোর অজুহাত দিয়ে গিয়ে মন্ত্রীদের মুখে অভিন্ন রকমের কারণ দর্শানো শুনে হয়তো জনগন বিরক্ত। এবার পরিকল্পনা মন্ত্রী নিজেই কৌশলী উত্তর দিলেন। হাসিমুখেই বলে দিলেন- "দেশে গড় আয়ু বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদও বেড়েছে।"

এই তো গেল পরিকল্পনা মন্ত্রীর রসিকতা! এবার তাকান আরেকজনের দিকে; যিনি এই প্রকল্পের মা-বাপ সবই। তিনি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের; যাঁর পদচারণায় প্রায় সময়ই মুখর থাকে রাস্তাঘাট।

চার লেনের কাজ অমুক মাসে শেষ হচ্ছে। তমুক মাস থেকে গাড়ি চলতে আর অসুবিধা নাই…। এমন সব কথা শুনতে আমাদের কান সর্বদা অভ্যস্থ। তাঁর বলা প্রথম কথাটিও যদি সত্যিই হতো, তবে এক বছর আগেই এই প্রকল্পের শতভাগ কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা।

এ কথা স্বীকার করা যায় যে, পুরো প্রকল্প শেষ না হলেও চার লেনের কাজ হয়ে গেছে এমন সড়ক যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত। ফলে আগের চাইতে সড়কপথের ভোগান্তি অনেকাংশেই কমেছে।

সর্বশেষ মেয়াদবৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদনকালে বলা হলো, গত জানুয়ারি পর্যন্ত এই প্রকল্পের মাঠপর্যায়ের কাজ শেষ হয়েছে ৮১ শতাংশ। বাকি ১৯ শতাংশ কাজ শেষ করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ১১ মাস সময় চেয়েছে। নিশ্চয়ই মেগা প্রকল্পের ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের যে কোনো সিদ্ধান্ত মন্ত্রীর তদারকিতেই হয়। তার ওপরও যে প্রকল্প নিয়ে মাননীয় মন্ত্রীর তৎপরতা দৃশ্যমান।

সময় বাড়ানোর ২৪ ঘণ্টা পর সেতুমন্ত্রী বললেন, আগামী মে মাসেই চার লেন প্রকল্প উদ্বোধন করতে পারবেন প্রধানমন্ত্রী। ছয় বছরের স্থলে ১১ বছরেও শেষ না হওয়া কাজ ১১ মাসের বদলে তিন মাসে কি করে সম্ভব করবেন মাননীয় মন্ত্রী?

যদি বর্ধিত মেয়াদের সাত মাস আগে কাজ শেষ করে উদ্বোধন করা সম্ভব হয়, তাহলে নতুন মেয়াদকাল ডিসেম্বর না হয়ে মে-জুন হলে অসুবিধা কী ছিল?

নাকি মন্ত্রীর আজকের বাণীও কোনো সুচিন্তিত বক্তব্য নয়, বাস্তবতানির্ভর তথ্য নয়, আগের মতো শুধুই ফাঁকাবুলি?

লেখক : সাংবাদিক, news.joynal@gmail.com