ওপার থেকে এক শিশুর মর্মস্পর্শী চিঠি

জয়নাল আবেদীন
Published : 26 Feb 2016, 05:23 AM
Updated : 26 Feb 2016, 05:23 AM

প্রিয় মা,

তোমার খোকা আজ অনেক দূরে। আমি জানি, আমাকে ছেড়ে থাকতে তোমার অনেক কষ্ট। চোখ মুছতে মুছতে তোমার শাড়ীর আঁচল ভিজে গেছে। এখনো কী তোমার চোখদুটো ভিজে যায় চোখের জলে? বোকা মা, শুধু শুধু কাঁদছো। আমি তো এখানেও খেলছি। আমি ভয় পাব ভেবে তুমি কাঁদছো? আমার সাথে বন্ধুরা আছে তো। তাজেল, মনির, ইসমাঈল- ওরা সবাই আছে। কত আনন্দ এখানে!

আমি জানি, এখনো সন্ধ্যা হলে বাড়ির উঠান ভেঙে তুমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকো। মাটির রাস্তায় দৃষ্টি যতদূর যায়, ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকো। তুমি তো জানো মা, এখান থেকে আর ফেরা যায় না। তবু কেন ফুরায় না তোমার অপেক্ষা?

তোমার বুকে ফিরে যেতে খুউব ইচ্ছে হয়। ইচ্ছে করে তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ি। কতদিন তুমি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দাও না। ঘুম পাড়ানির গান শোনাও না।

আমার পথ চেয়ে যখন দাঁড়িয়েই থাকো, তবে আরো কিছুটা সময় অপেক্ষা করো। সন্ধ্যার পর আবছা অন্ধকারে আকাশে প্রথম যে তারাটি জ্বলে উঠবে, সেটিই তোমার বুকের মানিক। রোজ সন্ধ্যায় আমাকে দেখে যেও। দূর থেকে এই ছেলেটি ঠিকই মাকে খুঁজে ফেরে।

আমি জানি- এখনো রোজ সকালে তুমি আমার পড়ার ঘরে যাও, আমাকে স্কুলে পাঠাবে বলে। তোমার বুকের মানিক যে সেই ঘরে নেই তুমি ভুলে যাও, তাই না? আমি তোমাকে ফাঁকি দিতে চাইনি মা। পৃথিবীর নিষ্ঠুর লোকগুলো মায়ের আদর থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে দিলো।

তুমি কী আমার গণিতের খাতার সাদা পৃষ্ঠাটি চোখের জলে নীল করো? ঐকিক নিয়মের অংকটির ওপর হাত বুলাও? আমার হাতের লেখা খুব পঁচা তাই না মা? তাতে কি। তুমি এই খাতাটি যতন করে রেখে দিও। ওখানেই আমাকে পাবে।

বাবা বুঝি আজো রাতে বাড়ি ফেরার সময় পকেটে করে ভাংতি টাকা নিয়ে আসে? পরদিন স্কুলে যাবার সময় আমাকে দেবে বলে! আমার আদরের বোনটি আজো ভাইয়াকে খুঁজে না? ওকে বলো- ওর ভাই বিদেশে গেছে। ফেরার সময় ওর জন্য রঙ-বেরঙের খেলনা আনবে।

আচ্ছা মা, বাবা কি এখনো আমায় বকা দেয়? বাবাকে বলে দাও না, সেদিন মাগরিবের আজানের আগেই ঘরে ফিরছিলাম।

ফুটবল খেলা দেখে হেঁটেই তো বাড়ি আসছিলাম। মাঝপথে বাচ্চু কাকা তার গাড়িতে তুলে নিলো। আমরা তার গাড়িতে উঠতে চাইনি। বাড়ি পৌঁছে দেবে বলাতেই উঠি।

জানো মা, একটু পরই দেখি গাড়ি অন্য রাস্তায় যাচ্ছে। তখন বুকটা ধড়পড় করতে থাকে। বাচ্চু কাকাকে বলি- কাকা, এদিকে কোথায় যাচ্ছেন? আমরা বাড়ি যাব। কাকা কিছুই বলে না। আবারও চেঁচাতে থাকি- কাকা আমাদের বাড়ি নিয়ে যাও। কাকা গাড়ি থামিয়ে আমাদের হাতে একটি করে আইসক্রিম দিলেন। সেটি খাওয়ার পর মাথাটা কেমন যেন ঘুরতে থাকে…।

হঠাৎ হুঁশ এলো তাজেলের কান্না শুনে। দেখি, একটা লোক ওর মুখ চেপে ধরলো। আমি তাজেল তাজেল বলে চেঁচাতে থাকি। বাচ্চু কাকার শক্ত হাতে আটকে থাকায় আমি ছুটে যেতে পারিনি। ওই লোকটি এবার তাজেলের গলা টিপে ধরে। কিছুক্ষণ পর ও হাত-পা ছেড়ে দিলো। ওর গলার স্বর বন্ধ হয়ে গেলো। ইসমাঈল আর মনির তখন কোথায় জানি না।

এক ঝাপটায় বাচ্চু কাকার হাত ছেড়ে আমি তাজেলের দিকে এগিয়ে যাই। তাজেল চোখ খোলো, কথা বলো….। তাজেল কথা বলে না। তাজেল চোখ খোলে না। ওর মুখ বেয়ে লালা গড়িয়ে পড়ে।

বুঝতে পারলাম, তাজেল আর কখনোই কথা বলবে না। চোখ খুলবে না কোনদিন। পাশের ঘর থেকে ইসমাঈল এবং মনিরকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এলো আরো কিছু লোক। এ দুজনও কথা বলে না। চোখ খোলে না। জানো মা, ওদের জন্য তখন আমি অনেক কেঁদেছি। আমার চোখের জলে ওই পাষণ্ড লোকগুলির মন ভিজেনি। তখনও বুঝিনি এই পৈশাচিকতা আমার নিয়তিতেও লেখা আছে।

বাচ্চু কাকা এগিয়ে এসে সজোরে চড় বসিয়ে দিলেন আমার গালে। তার বিশাল পায়ের লাথি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। বিশ্বাস করো মা, তখন শুধু তোমার কথাই মনে পড়ছিল। তোমার মনে আছে, একবার বাবা আমাকে চড় মেরেছিল। আর তুমি বুকের ভেতরে আমার মাথাটা নিয়ে অনেকক্ষণ কেঁদেছিলে! আমি একটু ব্যাথা পেলেই তুমি অনেক কষ্ট পেতে।

তোমার সেই আদুরে ছেলেটির ওপর ওরা কত নিষ্ঠুরতা দেখালো! তখন শুধু তোমাকেই ডাকছিলাম- মাগো, তুমি কই, আমাকে নিয়ে যাও, আমাকে বাঁচাও। তুমি তো অনেক দূরে। আমার ডাক তোমার কানে পৌঁছায়নি।

তাজেলের মতো ওরা আমার মুখটাও চেপে ধরলো। আমি আর কাঁদতেও পারি না। ভেতরে নিঃশ্বাসগুলো আটকে গেলো। বাচ্চু কাকার হাত থেকে মুখটা ছাড়িয়ে নিতে কত চেষ্টা করেছি। বড় বড় লোকগুলোর হাত আমি সরাতে পারিনি। আমার কী আর ওদের মতো এত শক্তি আছে!

জানো মা, ওরা শুধু আমার মুখটা চেপে ধরেনি; গলাও টিপে ধরেছিল। তখনও আমার চোখের সামনে শুধু তোমার ছবি ভেসে উঠছিল। তোমাকে ডাকছিলাম, কিন্তু আওয়াজটা ভেতরেই আটকে থাকে।

আমার সেই অব্যক্ত আর্তনাদ শুনে মাথা ঠিক রাখতে পারতে না মা। আমি পাগলের মতো করেছি। অনেকক্ষণ মুখটা চেপে ধরার পর আমার সমস্ত শক্তি ক্ষয়ে গেলো। দু চোখে অন্ধকার নেমে এলো। হাত-পা সবকিছুই শিরশিরিয়ে ওঠে। মস্তিস্ক শীতল হয়ে ওঠে। ওদের ভয়ংকর হাতের তাণ্ডবলীলা একসময় থেমে গেলো। অমনি এক ফুৎকারে বেরিয়ে গেলো আমার বুকের ভেতরে জমে থাকা নিঃশ্বাসটা।

তুমি আমাকে কত গল্প শুনিয়েছো। অথচ এমন কিছু কখনো বলোনি। আমি তো জানতাম না, শেষ নিঃশ্বাসটা বেরিয়ে গেলে মানুষ আর বেঁচে থাকে না! নিঃশ্বাসের আসা-যাওয়া বন্ধ হলে মানুষকে মৃত বলা হয়!

আমাকে আগে কেন বলনি মা? আগে যদি বলতে, আমি কি আর এত কষ্ট করি! ওরা আমার মুখ চেপে ধরার আগেই তো শেষ নিঃশ্বাসটি বের করে তুলে দিতাম ওদের হাতে। অন্তত এই নির্মমতা থেকে বাঁচা যেত।

আরো বহুকাল বাঁচার খুব ইচ্ছে ছিল তোমার মমতায়। সন্ধ্যা হলে এখনো তোমার বুকে ফিরতে মন চায়। ইচ্ছে করে, তোমার আঁচল ধরে ছুটে চলি এ ঘর থেকে ও ঘর।

যেদিন তোমার কোল আলো করেছিলাম, সেদিন থেকে কখনো তুমি আমাকে আলাদা করোনি। সেই তুমি আমাকে ছাড়া কী করে দিন কাটাও মা? আমি জানি, তোমার বুকে শোকের পাথর জমে গেছে। তোমার খোকা আজ অনেক দূরে। কী করে তোমার বুক থেকে এই পাথর সরিয়ে দেবে?

আমার লক্ষ্মী মা, একদম কাঁদবে না। তুমি যখন আমার কাছে আসবে, দেখবে কত সাজানো-গোছানো এপারের জগতটা। এখানে পৃথিবীর মতো পৈশাচিকতা নেই, নির্মমতা নেই। এখানে আমার অনেক বন্ধু। আমরা রোজ বিকেলে খেলি। হইচই করি। শুধু তোমার কথা মনে পড়লে মন খারাপ করি।

তাজেল, মনির এবং ইসমাঈলের মায়েদের বলে দিও, তাদের বুকের মানিকরাও ভালো আছে। ওদেরকেও বলো, সন্ধ্যা হলে যেন ঠিকই ঘর থেকে বেরিয়ে উঠানে দাঁড়ায়। আকাশপানে তাকিয়ে যেন আরো তিনটি তারা খোঁজে। আমার পর যে তিনটি তারা জ্বলে উঠবে, সেগুলোই তাজেল-মনির-ইসমাঈল।

আমার মা যদি সত্যিই তার খোকাকে ভালোবাসে, তাহলে শাড়ীর আঁচল আর ভেজাবে না। আর এক ফোঁটাও চোখের জল ফেলবে না। মধ্যরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে ডান হাতের নিচে শূন্যতা অনুভব করলে কেঁদো না। তোমার খোকা আছে ভেবে ঘুম পাড়ানির সেই গানটি শুনিয়ে দিও। এই আকাশ থেকে আমি কান পেতে রবো।

ভোরের আবছা আলোয় ঘুম ভাঙলে পূবের দরজাটি খুলে দিও। একটু পরই দেখবে পুরো ঘরটি জেগে উঠেছে এক ফালি রোদের আলোয়। ভেবে নিও, তোমার প্রতিটি সকালের আলো তোমারই হারিয়ে যাওয়া শুভ।

লেখক : সাংবাদিক, news.joynal@gmail.com

[হবিগঞ্জের বাহুবলে একসঙ্গে চার শিশুকে হত্যার পর লাশ বালুচাপা দেওয়া হয়। হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্তদের জবানবন্দির সঙ্গে কল্পনার মিশেলে লেখা হয়েছে এই চিঠি]