বলতে গেলে অনেক কথা। ২৭ ফেব্রুয়ারি রাত ২টা থেকে আজ দুপুর পর্যন্ত বহু কথা বলা হয়নি। একে একে সবই শেয়ার করতে চাই। আজ একটি ইনজেকশনের গল্প। যে গল্পে একইসঙ্গে আনন্দ-বেদনা এবং ক্ষোভ-দুর্ভোগ মিশে একাকার।
ঘাম ঝরানো দৌঁড়ঝাপ এবং হাজারো শংকার মেঘ কাটিয়ে অবশেষে আমার শ্বশুর শংকামুক্ত। আল্লাহর অশেষ রহমতে এই যাত্রায়ও তিনি বাঁচলেন।
ঝুঁকির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেও তাঁর বেঁচে যাওয়ার নেপথ্যে একটি ইনজেকশন- কার্ডিনেক্স ৬০ এমজি। দাম মাত্র ৪৫০ টাকা হলেও এর ভূমিকাটি অতুলনীয়। শুধু পাঁচ লাখ টাকা বাঁচিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি, বাঁচিয়ে দিয়েছে একজন মানুষের জীবনের অনেক রকমের শংকা।
কদিন ধরে এই একটি বিষয় নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় ছিলাম। অনেক কিছুই শেয়ার করা সম্ভব হয়নি। অনাহারে সিরিয়ার হাজারো মানুষের করুণ মৃত্যুর একটি ব্রেকিং নিউজ দেখে বুকটা কেঁপে ওঠে কাল বিকেলে। জানি না, আরো কত খবর মিস হয়েছে।
প্রায় ছয় বছর আগে বিনা চিকিৎসায় আমার বাবা মারা যান। বাবার শূন্যতা বাদ দিলে মাকে নিয়ে আমাদের সুখের সংসার।
যতকিছুই হোক, বাবার শূন্যতা অপুরণীয়। তবে তিন বছর ধরে আমার সেই শূন্যতা কিছুটা হলেও লাঘব হয় একজন বন্ধুবৎসল, সজ্জল, প্রাণোচ্ছ্বল শ্বশুর পেয়ে। তিনি আমাদের কখনো অসুখে রাখেননি। ঠিক বাবার মতোই বটতলার ছায়া হয়ে থাকেন।
তিনি আমাদের নিশ্চিন্তে রাখতে চাইলেও আমরা তাঁকে নিয়ে থাকি দুশ্চিন্তায়। কত শত রোগ তাঁর শরীরে বাসা বেঁধেছে, ওপর থেকে দেখে বোঝা দায়। ডায়াবেটিসের সঙ্গে বেশকিছুদিন ধরে ঘাপটি মেরে আছে উচ্চ রক্তচাপ।
মাত্র তিনমাস আগে বলতে গেলে আল্লাহ তাঁকে নতুন জীবন দিয়েছিলেন। নইলে রক্তচাপের মাত্রা ২০০-এর ওপরে চলে গিয়েও ক্যামনে ঠিক থাকলেন?
সেবার বেঁচে গেলেও এবার ঠিকই মরতে বসেছিলেন। ২৭ ফেব্রুয়ারি রাত দেড়টার দিকে আবারও ধাক্কা। এবার বেশ বড়সড় ধাক্কাই ছিল। গভীর রাতে ঢাকার রাজপথ ফাঁকা এবং বাসার পাশে হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স হয়ে গেল আমাদের অন্ধের যষ্ঠি।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাই স্কয়ার হাসপাতালে। এই হাসপাতালের এসকেলেটর, লিফট, মেঝে, ইমারজেন্সি, কেবিন আর ডাক্তারদের চেম্বারগুলোর ধূলো মুছলেও যায় না। আমাদের পা কদিন পরপরই পড়ে।
প্রায় আড়াই ঘণ্টা ইমারজেন্সিতে নানা রকমের পরীক্ষা-নীরিক্ষার পর প্রমাণ হলো- শ্বশুর মশাইয়ের হার্ট এবার অ্যাটাক! ওপর থেকে তাঁকে স্বাভাবিক মনে হলেও ভেতরে তখনো টর্নেডো বইছিল!
এমন একটি মুহূর্তে স্কয়ার হাসপাতাল আমাদের রাখল না শুধুমাত্র সিসিইউতে থাকতে চাইনি বলে। কেন থাকতে চাইনি, সেই গল্প অন্যদিন।
এরপর আমরা চলে যাই বারডেমে, তারপর ইব্রাহিম কার্ডিয়াক। বারডেমে ডাক্তার নেই, ইব্রাহিম কার্ডয়াকে ডাক্তার থাকলেও তারা প্রথমেই শুরু করেন দর কষাকষি।
বেগতিক পরিস্থিতিতে ভোরের আবছা আলোয় শ্বশুর মশাইকে নিয়ে চলে যায় জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালে। জায়গা অসংকুলানের পরিস্থিতিতে সেখানকার মেঝেতেই থাকতে হলো রোগীর জীবন বাঁচানোর তাগিদে।
সরকারি হাসপাতাল সম্পর্কে ধারণা যে একদম ছিল না তা নয়, কিন্তু এটি যেন সবকিছু ছাড়িয়ে। বিড়াল, তেলাপোকা থেকে শুরু করে হরেক পদের পোকামাকড়ের দৌরাত্ম দেখে ঘাবড়ে যাই। দুদিনের মাথায় ঘটনাস্থল ত্যাগে বাধ্য।
সেই সাঁজ সকালে আড়মোড়া ভেঙে দুয়ার খুলে বেরিয়ে এসেছিলেন সরকারি ডাক্তার। তিনি তখন থেকেই ইনজেকশন পুশ করতে ভোলেননি। আর সেটিই শেষপর্যন্ত হয়ে ওঠে সোনায় সোহাগা।
ওই হাসপাতাল থেকে অনেকটা পালিয়ে আবারও চলে যাই স্কয়ার হাসপাতালে। কার্ডিওলজি বিশেষজ্ঞ শ্বশুরকে দেখেই হাসপাতালে ভর্তি নেন। রোগীর হার্টে যে একাধিক এবং মারাত্মক অবস্থায় ব্লক থাকার তীব্র আশংকা ছিল, সবই মিথ্যে হয়ে গেল গতকালের এনজিওগ্রামে।
আশংকা কিন্তু মিথ্যে হয়নি, সেই সাঁজ সকালে আড়মোড়া ভেঙে দুয়ার খুলে বেরিয়ে আসা সরকারি ডাক্তারের ইনজেকশনই হার্টে ব্লক তৈরির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। তাতেই বাঁচলেন শ্বশুর মশাই।
অথচ হৃদরোগ হাসপাতালে ডাক্তার সাহেব বলেছিলেন, রোগীর হার্টে ব্লক থাকার আশংকা ৯৯ শতাংশ। আমাকে নির্জনে ডেকে একটি চার্টও দেখান। আমেরিকান, ইউরোপীয়ান এবং সাধারণ- তিন ধরনের রিং পরানোর ক্ষেত্রে তিন রকমের হিসাব।
শুধু তাই নয়, রিং পরানোর জন্য টাকাটাও জমা দিতে হবে আগেভাগে। এনজিওগ্রামে যদি ব্লক ধরা না পড়ে, তাহলে… এই জাতীয় কোনো কথা সরকারি ডাক্তারের মুখে একবারের জন্যেও বেরোলো না।
স্কয়ার হাসপাতালের ডাক্তার ব্লক থাকার আশংকা করেছেন সত্যি, তিনি এও বলেছেন যে, ব্লক না থাকলে আর কোনো ঝামেলা নেই। সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালের পরিবেশ দুই রকম সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু ডাক্তারদের মধ্যেও যদি জালিয়াতি থাকে, সেটি মানবো কী করে?
জালিয়াতিটা আজ পরিস্কার হলো। সরকারি ডাক্তার অপারেশন থিয়েটার থেকে একটু পর বেরিয়ে হয়তো বলতেন, আপনার রোগীর দুটি বা তিনটি ব্লক ধরা পড়েছে। আমেরিকান প্রতিটি ব্লকের মূল্য ১ লাখ ৭২ হাজার টাকা। টাকা জমা দিয়ে দেন…
রোগীর জীবন বাঁচানোর বিষয় মাথায় রেখে আমাকে/আমাদেরকে অবশ্যই ডাক্তারের পথই অনুসরণ করতে হতো। কারণ, আমরা এখনো মনে করি- মানুষের জীবন বাঁচানোর ক্ষেত্রে ভরসার জায়গা থেকে ওপরওয়ালার পরেই ডাক্তারদের স্থান।
গতকাল আরো একটি ভয়ংকর তথ্য পেয়েছি। ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে স্কয়ার হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আমরা যার অধীনে চিকিৎসা পেয়েছি, মূলত তিনি কোনো ডাক্তার নন! ডাক্তারের বেশ ধরে ছিলেন মাত্র!
আজ এটিও বুঝতে পারছি যে, সেদিন কেন তিনি আমাদের সঠিক তথ্য দিতে পারেননি। কেন সেদিন তিনি প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ একজন রোগীকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য করলেন! ডাক্তারবেশি সেই অমানুষটা একবারের জন্যেও সেই ভোরে বলেননি যে, রোগী হার্ট অ্যাটাক করেছেন এবং তাঁর একটি ইনজেকশন দেওয়া জরুরি।
আজ এনজিওগ্রামের পর যখন বোঝা গেল, ব্লক না থাকার পেছনে ওই একটি ইনজেকশনের ভূমিকাই আসল, তখন সরকারি ডাক্তারের ওপর শ্রদ্ধাবনত হয়ে পড়ি। আবার যখন ভাবি, সেই একই ডাক্তার জালিয়াতির চিন্তা থেকে ব্লক থাকার ৯৯ ভাগ শংকা দাবি করে আগাম টাকা চেয়েছিলেন, তখন শুধু একমুখ দীর্ঘশ্বাস নয়, চরম ঘৃণাও।
আবার স্কয়ার হাসপাতালের উদার মানসিকতার পরিচায়ক ডাক্তারের আচরণ এবং চিকিৎসার প্রতিও বিমন্র শদ্ধা আছে যেমন, সেই গভীর রাতের ডাক্তারবেশি অমানুষটির প্রতিও ঘৃণা।
সরকারি আর বেসরকারি- কোনো হাসপাতালই আজ সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়। ভরসা নেই ডাক্তারদের ওপরও। এখন ক্যামনে আর বলি, জীবন বাঁচানোর ক্ষেত্রে ওপরওয়ালার পরই ডাক্তারদের স্থান?
সবকিছু ছাপিয়ে আজ একটি ইনজেকশন- কার্ডিনেক্স ৬০ এমজি। এই ইনজেকশনটির ওপরই বড় কৃতজ্ঞতা।
উচ্চ রক্তচাপ থেকে সবার জীবন নিরাপদ থাকুক।
>> লেখক : সাংবাদিক, news.joynal@gmail.com