সন্তান হন্তারক মা এবং গণমাধ্যমের ক্রান্তিকাল

জয়নাল আবেদীন
Published : 4 March 2016, 06:18 PM
Updated : 4 March 2016, 06:18 PM
মফস্বলের একটি উপজেলা থেকে নিউজের আশায় বসে আছি। সাংবাদিক ফোনে জানিয়ে দিলেন লোডশেডিং চলছে। বিদ্যুৎ এলেই খবরটি পাঠিয়ে দেবেন। ঘণ্টা দুয়েক পর আবারও সেই সাংবাদিকের ফোন- 'ভাই, বিদ্যুৎ এসে গেছে, খবরটা আপনাকে মেইল করছি'। আমি মেইল থেকে ডাউনলোড করে ফাইলটি ওপেন করি। শিরোনাম দেখেই আমার চোখ কপালে!
দুই ঘণ্টা লোডশেডিংয়ে ভূগে পাঠানো খবরটির শিরোনাম-
'দেশে এখন এক মিনিটও লোডশেডিং নেই : মন্ত্রী'
বিদ্যুৎ উন্নয়নের ধারাবাহিক রেকর্ড আমরা প্রায়ই দেখছি। লোডশেডিং আগের চাইতে অনেকটাই কমেছে। সবই ঠিক আছে। তবে এক মিনিটও লোডশেডিং নেই- এই তথ্য কোনো দৃষ্টি প্রতিবন্ধীও বিশ্বাস করবেন বলে মনে হয় না।
মন্ত্রী বলেছেন মন্ত্রীর কথা। সাংবাদিক সাহেব হুবহু মন্ত্রীর উক্তিটা কোড করে লিখে দিলেন। আর আবছা অন্ধকার কেটে ভোরের সূর্য উদয় হলেই ক্ষুধার্ত পাঠকেরা গিলতে থাকেন এই অখাদ্য।
পাঠকের চাহিদা বুঝতে না পেরে সত্যিটা অনুসন্ধানের তৃষ্ণা কেটে গেছে হয়তো, তাই মন্ত্রীর বলা কথাটি হুবহু তুলে ধরার নামই এই সময়ের সাংবাদিকতা!
নইলে র‌্যাবের দেওয়া প্রেসক্রিপশন যাচাই না করেই প্রথম সারির গণমাধ্যমগুলো কী করে লিখতে পারে শুধু হতাশা থেকেই নিজের পেট থেকে বের হওয়া দুই সন্তানকে খুন করেছেন মা?
বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করতে গিয়ে আমরা সত্যানুসন্ধানের কথাটি গিলে ফেলেছি তো! গেল ক বছরে ডজন ডজন কাগজ এসেছে, টিভি চ্যানেল বেড়েছে। নিউজপোর্টাল তো ঘরে ঘরে। কোথাও দেখেছেন বনশ্রীর দুই ভাই-বোন খুনের আসল রহস্য?
বস্তুনিষ্ঠ খবর লিখতে গিয়ে আমরা সত্যকে কিভাবে পেছনে ফেলে আসছি তার একটা নমুনা দেখাই-
এক কান দুই কান করে খবর ছড়িয়ে পড়লো, নিমতলা সুপার মার্কেটের সামনে একটি জিনিষ পড়ে আছে। মানুষ আতংকে ধারেকাছেই ভিড়ছে না।
খবর পেয়ে ছুটে গেলেন একঝাঁক সাংবাদিক। সুপার মার্কেটের সামনে জিনিষটি যেখানে পড়ে আছে, তার পূর্ব পাশে অবস্থান নিলেন একদল সাংবাদিক। আরেকটি দল দাঁড়ালেন পশ্চিম পাশে। কিছুক্ষণের মধ্যে সরাসরি সম্প্রচার শুরু হলো।
'চ্যানেল এ' ব্রেকিং দিয়েছে- নিমতলা সুপার মার্কেটের সামনে একটি 9 পড়ে আছে!
'চ্যানেল বি' ব্রেকিং দিয়েছে- নিমতলা সুপার মার্কেটের সামনে একটি 6 পড়ে আছে!
কী মুশকিল! কেউ বলছে 9, কারো দাবি 6!
পাশাপাশি দোকানে বসে টিভির খবর দেখছিলেন আবুল এবং বাবুল। খবর শেষ। বিষয়টি নিয়ে গ্রামের বাজারে জোর আলোচনা। জট বাঁধলো আবুল আর বাবুলে। একজন বলছেন নিমতলায় 9 পড়ে আছে, অন্যজন জোরগলায় বলছেন না, 6-ই পড়ে আছে নিমতলায়।
আবুল-বাবুলের মতো অতি উৎসাহী দর্শক এবং পাঠকের অভাব নেই সোনার বাংলায়। ঘরে ভাতের খবর না থাকলেও কোথায় কি ফালতু খবর ঘটছে সেগুলো নিয়ে বেশ হইচইয়ে মাতেন। একেক চ্যানেলে/কাগজে একেক রকমের তথ্যভিত্তিক খবর গিলে তারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করেই মজা লুটেন!
আমাদের দেশে গণমাধ্যমে কত রকমের খবর ছাপা হয়। মিথ্যা খবরের প্রতিবাদ জানাতে গেলে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক নিজের কাছে অতিযতনে রক্ষিত নথিপত্র দেখিয়ে উষ্মা ছাড়েন- আমি বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করি, হুম।
তাঁর দাবি একদম ঠিক। তিনি আসলেই বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করেন। মন্ত্রী দাবি করেছেন, দেশে এই মুহূর্তে এক মিনিটও লোডশেডিং নাই। র‌্যাব বলেছে, বনশ্রীর নুসরাত-আলভীকে তাদের মা খুন করেছে হতাশা থেকে।
এই তথ্যগুলো বস্তুনিষ্ঠ।
কিন্তু এগুলোর সত্যনিষ্ঠতা খুঁজতে গেছেন কজন? নাকি সেই মানসিকতাই নাই? সত্যানুসন্ধানের ইচ্ছা থাকলে কোনো সাংবাদিক কি আর লোডশেডিংয়ে আক্রান্ত হয়েও লিখতে পারেন, দেশে এক মিনিটও লোডশেডিং নাই?
এই বস্তুনিষ্ঠ জাতের সাংবাদিকতার কাছে আজ পুরো গণমাধ্যম পাঠকের কাঠগড়ায়।
সকাল থেকে লোডশেডিংয়ে ভূগছি বলেই এত কথার সূত্রপাত। আজ শুক্রবার, তবু কাল রাতে ভালো ঘুম হয়নি। চোখের পাতা এক হওয়ার আগ পর্যন্ত বনশ্রীর দুই ভাই-বোন হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে অনুসন্ধানী খবরের সন্ধানে ছিলাম।
ইত্তেফাকের লিড নিউজটা তখনই পড়েছি। এরপর প্রথম আলো-কালের কণ্ঠ-সমকাল এবং প্রথম সারির নিউজপোর্টালগুলো বারবার খুলে দেখছিলাম। সবখানেই ঘুরেফিরে র‌্যাবের দেওয়া তথ্যগুলোই- ভবিষ্যতে মানুষ হতে পারবেন না ভেবেই নাকি মা তার নিজ সন্তানদের গলাটিপে মেরে ফেলেছেন!
প্রথম আলো অবশ্য একটি বাড়তি তথ্য দিয়েছে-
'নুসরাত ও আলভীর লেখাপড়া নিয়ে মায়ের উদ্বেগ কেন? তারা লেখাপড়ায় খারাপ ছিল? এ ব্যাপারে ওদের স্কুলে যোগাযোগ করা হয়। ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ২০১৪ সালের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষায় নুসরাত ৮২০ নম্বরের মধ্যে ৫২৭ নম্বর পেয়েছিল। ক্লাসে ১১০ দিনের মধ্যে ৯৮ দিন উপস্থিত ছিল। নুসরাতের পড়ালেখা সম্পর্কে স্কুলটির অধ্যক্ষ সুফিয়া খাতুন বলেন, 'নুসরাতের শ্রেণিশিক্ষককে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ওর ফল ভালো ছিল। খুব সৃষ্টিশীল ছিল, ভালো ছবি আঁকত।'
নুসরাত-আলভী হত্যাকাণ্ডের খবর প্রচারে মিডিয়া নৈতিকতার দিক থেকেও ফেল! খবর প্রকাশ এবং প্রচারের ধরনে অনেক ঘাটতি আছে বলেই আমার ধারণা। এই খবরগুলো নানা বয়সী সতের কোটি মানুষের মনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
আমার এক বন্ধু বলেছেন, 'এখন থেকে আমার বাচ্চাদের জন্য নিজের বউকে নিরাপদ মনে হয় না। অপ্রিয় হলেও এটাই আজকের বাস্তবতা।'
এক দুই করে হয়তো শিশুরাও বলে উঠবে- 'মা, তুমি আমায় গলাটিপে খুন করবে না তো?'
জানি না, একজন মায়ের কাছে ওই মুহূর্তটি কতটা বেদনাদায়ক। বনশ্রীর মাহফুজা নামের এই নারীকে আপাতত মা বলতে আমার ঘৃণা হয়। যিনি জঘণ্য হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে মা শব্দটির সংজ্ঞাকেই বিপদে ঠেলে দিলেন, তিনি আর যাই হোন, মা হতে পারেন না।
রাজনৈতিক সংকট দেখা দিলেই আমরা বলি, দেশে ক্রান্তিকাল চলছে। এটা কতখানি সত্য এবং বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে যথেষ্ঠ প্রশ্ন আছে। আমি বলব, ঠিক এই মুহূর্তে দেশে ক্রান্তিকাল চলছে। যে দেশের শিশুদের কাছে মায়ের কোল নিরাপদ নয়, যে দেশে শিশুদের খুন করে মায়ের হাত রঞ্জিত হয়, সে দেশ শুধু ক্রান্তিকাল নয়, ক্রান্তির সর্বোচ্চ শিখরে চড়ে ওঠে।
আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, শুধু দেশের নয়, ক্রান্তিকাল গণমাধ্যমেও! অথচ দেশের এই সর্বোত্রম ক্রান্তিলগ্নে গণমাধ্যমের ভূমিকা সবার আগে থাকা উচিত। আর, সেক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতা নয়, জয় হোক সত্যবাদি সাংবাদিকতার।

>> লেখক : সাংবাদিক, news.joynal@gmail.com