মুক্তিযুদ্ধের সেই কিশোরী

জয়নাল আবেদীন
Published : 11 March 2016, 02:26 PM
Updated : 11 March 2016, 02:26 PM

ফজরের আজান তখনও হয়নি। দুয়ার খুলতেই ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাবার ডাকে আচমকা ঘুম ভাঙে আনোয়ারার। চোখ মেলে দেখে, সামনে কেবল বাবা নন, মা-ও দাঁড়িয়ে।

বাবা ফিসফিসিয়ে বলেন- তাড়াতাড়ি ওঠ। আমাদের এক্ষুণি বেরোতে হবে।

– কেন বের হবে বাবা? এই রাতে কোথায় যাইবা?

– তুই এতকিছু বুঝবি না। তাড়াতাড়ি যেতে হবে, ওঠ।

খানিক বাদে মুয়াজ্জিনের আজান কানে এলো। স্ত্রী আর কন্যাকে নিয়ে হেঁটে চলেছেন নূরুল ইসলাম। আঁকাবাঁকা মেঠোপথ পেরিয়ে ধানি জমিতে তাদের পা। পথিকের পায়ের চাপে জমির মাঝখানে সরু রাস্তা হয়ে গেছে। সেই পথ ধরেই এগোন তারা।

পশ্চিমে নানার বাড়ি, উত্তর-দক্ষিণও আত্মীয়-স্বজনে ভরা। অথচ তারা ছুটলেন পূবে। আরে ওদিকে তো পাহাড় আর গহীন জঙ্গল। আনোয়ারা কোনমতেই হিসাব মেলাতে পারছে না।

মনে মনে বাবাকে বকছে তো বকছেই-

– আব্বা বোধোয় পাগল হয়ে গেছে। পাহাড় জঙ্গলের দিকে কই যে নিয়া যায়, আল্লায় জানে…

কমপক্ষে ছয় কিলোমিটার হেঁটেছেন। যেদিকে যাচ্ছেন, সেদিক থেকে সূর্যটা ততক্ষণে উঁকি মেরেছে। সবুজ প্রকৃতি ধীরে ধীরে জাগছে। পখিদের ঘুমও ভেঙেছে। আশেপাশের ছোটখাটো টিলা-পাহাড় থেকে নানা রকমের পাখপাখালির কলতান।

আরো কিছুক্ষণ হাঁটার পর থামলেন নূরুল ইসলাম। আনোয়ারা দেখলেন, সেই জায়গাটি আগে থেকেই মুখর অনেক লোকে। পাহাড়ের ভেতরেই মাথা গুঁজে আছে বহু মানুষ।

পাহাড়ের মাঝামাঝিতে এক পাশে বানানো হয়েছে বেশ কয়েকটি সুড়ঙ্গ। ভেতরে কোনমতে থাকার বিশাল জায়গা। বাইরে থেকে বোঝাই যায় না, ভেতরে কেউ থাকতে পারে। এ রকম এক সুড়ঙ্গের ভেতরেই জায়গা হলো আনোয়ারাদের।

কিশোরী মেয়েটি ততক্ষণে বিষয়টি আঁচ করতে পেরেছে। কেন ঘুটঘুটে অন্ধকার না কাটতেই ঘর ছেড়ে বেরোতে হলো তাদের। স্ত্রী-কন্যা নিয়ে নূরুল ইসলামের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল কেন, সেটিও এখন পানির মতো সহজ।

তখন যেটি চলছিল সেটি যুদ্ধ নয়, অত্যাচার। আসল যুদ্ধ শুরু হয়েছে নিরস্ত্র বাঙালিরা যেদিন থেকে অস্ত্র ধরতে শিখেছে। যেদিন থেকে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়তে বুকে বল পেয়েছে।

তার আগে পরিস্থিতিটা ছিল একচেটিয়া পাকিস্তানিদের। সুযোগ নিয়ে তারা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। বাড়িঘর পুড়িয়েই থেমে থাকেনি, ঘরের বউ-কন্যাদের ধরে ধরে নিয়ে নির্যাতনের মতো বিভীষিকাও শুরু হয়।

রাতে চায়ের আড্ডায় খবরটি শুনে আর এক মুহূর্ত দেরি করেননি। ঘরে ঢুকেই প্রথমে মেয়ের কক্ষে যান নূরুল ইসলাম। মেয়ের নিষ্পাপ মুখটি দেখে তিনি চোখের পানি ফেলে দেন। ওই রাতেই নিজের সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেন।

প্রতিবেশীদের অনেকে আগেই বাড়ি ছেড়েছেন। নূরুল ইসলাম বাড়ির মায়া ছাড়তে চাননি। ভেবেছেন, তাঁদের কিছুই হবে না। শেষপর্যন্ত পরিবর্তিত পরিস্থিতির কাছে তিনি নত হলেন। স্ত্রী-কন্যাকে রক্ষা করতে ধরলেন পাহাড়ের পথ।

দুদিন হলো, আনোয়ারাদের পাহাড়বাস কাটে না। এর মধ্যে সেখানকার দুজন সাহসী পুরুষ বের হয়ে বাজার করে আনেন। পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার-দাবার নিয়ে তারা দীর্ঘদিন সেখানে থাকার প্রস্তুতি নেন।

এর মধ্যে খবর এলো- নূরুল ইসলামের বাড়িতে হানা দিয়েছে পাক হানাদারের দল। পুরো বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ধানের গোলা জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেওয়া হয়েছে।

ধানের গোলা ছাই হয়ে যাওয়ার খবর শুনে পড়ে গেলেন নূরুল ইসলাম। ভড়কে গেলেন আনোয়ারার মা। না, তেমন কিছু হয়নি। মাথায় পানি ঢালার পর চোখ খুললেন নূরুল। বুক থাপড়াতে থাকেন। এক গোলা ধান তার সারা বছরের কষ্টের ফসল। সারা বছরের ঘামের ফসল।

কারো বাধাই মানেন না, ছুটে চলেন বাড়ির পথে। যাওয়ার আগে স্ত্রীকে বলেন, আমি যদি না ফিরি, পাশে পাকিস্তানি ক্যাম্প থেকে একসময় লাশটা খুঁজে নিও। খবরদার আমার মেয়েকে এখান থেকে এক পা-ও বেরোতে দিও না।

বাড়িতে গিয়ে তিনি আর বাড়ি খুঁজে পান না। নিজের ঘরের সীমানা খুঁজতেই যেন কষ্ট হয়। একসঙ্গে সবগুলো বাড়ি তারা জ্বালিয়ে দেয়। ধানের গোলার সামনে গিয়ে অঝোরে কাঁদেন পরিশ্রমী মানুষটি। তাঁর সারা বছরের কষ্ট ওরা নিমিষেই ছাই করে দিলো!

আবার ফিরে গেলেন পাহাড়ে। সেখানকার সবাই তাঁকে ঘিরে ধরলো। জানার ব্যাপক কৌতূহল! পাকিস্তানিরা কি ভয়ংকর অবস্থা শুরু করেছে, তার কিছু বর্ণনা শোনালেন।

নূরুল ইসলাম এবং তার মতো আরো কয়েকজন পুরুষ অবর্ণনীয় কষ্ট করেন তাদের স্ত্রী-কন্যাদের মুখে এক মুঠো খাবার তুলে দিতে। এক, দুই মাস নয়, টানা নয় মাস তাদের কাটে গহীন পাহাড়েই।

এক বিকেলে আনোয়ারার বুকটা দুমড়ে-মুছড়ে ওঠে!

সেদিন ছিল ৮ ডিসেম্বর। সকালে বেরিয়ে সারাদিন আর ফেরেননি বাবা। বিকেলে দূরে চোখ যেতেই দেখা গেলো, তার বাবা খুব দ্রুতবেগে ছুটে আসছেন। সামনে এসেই হাঁফাতে থাকেন।

সুড়ঙ্গ থেকে একে একে সকলেই বেরিয়ে এলেন। সবাই বিমর্ষ দৃষ্টিতে বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

– কী হয়েছে বাবা?

– কী হয়েছে কাকা?

– কারো কোনো ক্ষতি হলো না তো মামা?

নানাজনের নানা প্রশ্ন। এর মধ্যে আনোয়ারার মা ছুটে এলেন। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন-

– আমার ছেলে কই? আমার ছেলের কিছু হয়ে যায়নি তো? কিছু বলছো না কেন?

বুক থেকে ভারী নিঃশ্বাসটা মাত্রই ছাড়লেন নূরুল ইসলাম। আর বলে উঠলেন-

– আজ থেকে আমরা স্বাধীন! আমরা স্বাধীন! আমাদের আর পাহাড়ের ভেতরে লুকিয়ে থাকতে হবে না।

ছেলে-বুড়ো সকলের মন আনন্দে নেচে ওঠে। তাদের দীর্ঘ নয়মাসের প্রতীক্ষা ফুরালো। তাড়াতাড়ি সবাই নিজেদের জিনিষপত্র গুছিয়েই ছুটে চলেছে। কিছুক্ষণ পর তারা আরো বেশি বিস্মিত হলো একটি দৃশ্য দেখে।

দূর থেকে আরো কয়েকটি পাহাড় থেকেও বেরিয়ে আসছেন অনেক মানুষ। সবাই তখন শ্বাস নিচ্ছেন মুক্ত আকাশের বিশালতায়। একযোগে সকলেই ছুটে চলেছেন। সেখান থেকেই কেউ একজন চিৎকার দিয়ে উঠলেন-

– জয় বাংলা…

অনেক রক্ত ঝরিয়ে পাওয়া দেশে সবাই তখন মুক্ত। কিশোরী আনোয়ারাদের আসল যুদ্ধ সবে শুরু। এই যুদ্ধ মাথাগোঁজার। তিল তিল করে আবার দাঁড়িয়ে যায় থাকার ঘর। নূরুল ইসলাম আবার বীজ কিনে ফসলি জমিতে হাল দেন।

মুক্তিযুদ্ধে কিশোরী আনোয়ারার অনেক স্মৃতি আছে। যখনই মনে পড়ে এক এক করে সব স্মৃতিই তিনি আমাদের শুনিয়েছেন। গল্প বলার দিনগুলি এখন হারিয়ে গেছে। তবে অনেকগুলি গল্পের মধ্যে নয় মাস ধরে গহীন পাহাড়ে নিজেদের আড়াল করে রাখার গল্পটি আজ মনে পড়ে গেলো।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সব দিক থেকেই অনন্য। এর নানা গল্প আমাদের আঁতকে দিতে পারে। অনেক পরে জন্ম হলেও গল্পগুলো কানে এলে হারিয়ে যাই সেই সময়ে।

পাহাড়ের সেই সুড়ঙ্গ এখন আর নেই। আনোয়ারাদের সেইসব স্মৃতি আজো জীবন্ত। গল্প নয়, এই সত্যিগুলো বেঁচে থাকবে হাজার বছর ধরে।

আরেকটি কথা-

মুক্তিযুদ্ধের সক্ষি সেই কিশোরী আনোয়ারা পরবর্তীতে বিয়ে করেছিলেন। আর, আমি তাঁরই সন্তান।

> লেখক : সাংবাদিক, news.joynal@gmail.com