এক টুকরো রাতের শহর

জয়নাল আবেদীন
Published : 13 March 2016, 06:58 PM
Updated : 13 March 2016, 06:58 PM
গুলিস্তান মানে শহরের ভেতর আরেক শহর। হরেক পদের পণ্য তো পাবেনই, সঙ্গে চিটার-বাটপারও। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের অংশ হিসেবে এখানে একটি স্থায়ী মাইক পাতা থাকে।
সারাদিন ননস্টপ বাজে-'ট্রাফিক আইন মেনে চলুন, আইন ভঙ্গকারীকে পুলিশে ধরিয়ে দিন; আপনার মানিব্যাগ সাবধানে রাখুন, ছিনতাইকারীকে হাতেনাতে ধরিয়ে দিন, নগদ টাকা পুরস্কার…'। এ তালিকায় যে নতুন বিষয় যোগ হয়েছে, সেটা টের পেলাম আজ- 'যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলবেন না…'।
এই নীতিবাক্য শুনে দু'জন হেসে উঠলাম। আবর্জনার শহরে পুলিশি মাইক বলে কি! এটি অনেকটা অন্ধকার ঘরে কাউকে বাতি বন্ধ করে দেওয়ার আহ্বান জানানোর মতো!
দুই.
 জাতীয় কবির মাজার পার হয়ে টিএসসির দিকে আসতে নিজেদের খুব আলোকিত লাগছিল। তাৎক্ষণিক আবিস্কার করলাম, সোডিয়াম বাতির বদলে সাদা বাতি লাগানো হয়েছে।
অন্ধকার রাতে এমন আলোর ঝলকানিতে একটি সেলফি তোলার খায়েশ জাগলো। আমার মোবাইল ইদানিং ফইন্নি রূপ নিয়েছে। কাগজে-কলমে স্টোরেজের অভাব না থাকলেও বাস্তবে নতুন একটি ছবি রাখার জায়গাও নাই! শান্তার ব্যাগ থেকে ওর মোবাইলটি বের করে ক্যামেরা অন করে যেই-ই পোজ দিব, অমনি আবার চলন্ত রিক্শা পৌঁছে গেলো সোডিয়াম বাতির মিটমিটে আলোয়। ছবি আর তোলা হলো না।
 তিন.
বঙ্গভবনের মোড়ে রিক্শাটি এমনভাবে টার্ন নিলো মনে হলো আমরা রাষ্ট্রপতির বাসায় নিমন্ত্রণে যাচ্ছি। শান্তা আমাকে বলে- ইশ! রাষ্ট্রপতি যদি আমাদের এক বেলার দাওয়াত দিতো…! আমি বলি- আগে কূটনীতি শেখো। দাওয়াত পেতে আর ‌'ইশ' করতে হবে না।
চার.
সেন্ট্রাল রোড ভেঙে খানখান। রিকশায় দু'জন যাত্রী, তবু ঝাঁকুনি প্রচণ্ড। অবচেতন মনে হুট করে বেরিয়ে এলো- উহ! রাস্তাটা এত ভেঙে গেছে যে…। রিক্শাচালক মামা বলে উঠলেন, এগুলো সব চক্রান্ত। বিস্ময়ে তাকে জিজ্ঞাসা করি- চক্রান্ত মানে?
– আরে মামা বোঝেন না, এখন রাস্তা ঠিক করলে ভোটের আগে কী কাজ করবে? ভোট ঘনিয়ে এলে তারা টেন্ডার করবে। ঠিক আগ মুহূর্তে কাজটা করে ঘরে ঘরে যাবে। আর বলবে- সেন্ট্রাল রোড দিয়ে আগে মানুষ বৃষ্টিতে চলাচল করতে পারতো না, আমাদের সরকার এই রাস্তা মেরামত করে এলাকাবাসীর কষ্ট লাঘব করেছে…। আমি তাকে থামিয়ে দিলাম। – আরে মামা, আপনি দেখি অনেক কিছুই বোঝেন। তো রিক্শা চালান কেন?
– (বত্রিশ পাটি বের করে হাসি) আমরা তো আর গরু না। সবই বুঝি। আমরা যে বুঝি, এটা তারাই বুঝতে চায় না। আমাদের তো কথা বলার সুযোগ নাই…
পাঁচ.
ঢাকার বাইরে থেকে যারা মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার হয়ে রাজধানীতে প্রবেশ করেন, তাদের চোখ কপালে ওঠে গেলেও যেতে পারে। কারণ, আকাশের সৌন্দর্যের কাছে পাতালের মাতাল করা পরিস্থিতি ঢেকেই থাকে।
এটা অনেকটা বাতির নিচে অন্ধকার। পুরো ফ্লাইওভারে নিচের ভগ্নদশা চোখে দেখলে একবাক্যে বলে ফেলবেন- আমরা গ্রামেই ভালো আছি। আসলে তা-ই। এই রাস্তা খালি ভাঙে, আর গড়ে। ভাঙে, আর গড়ে। শুধু আফসোস করি। আর বলি, এই রাস্তার যে কী হলো! মেরামত করলেও খালি ভাঙে…। জয়কালি মন্দির পার হয়ে এদিকে আসতেই দেখি, রাস্তার একপাশ উল্টে গেছে।
এই লেখার সঙ্গে যে ছবিটি দিয়েছি, সেটি আরেকবার দেখুন। কিছু নারী ভীষণ কর্মব্যস্ত। তারাই রাস্তাটি মেরামত করছেন। সাদাচোখে এটি প্রশংসনীয় ঘটনা, আজকাল নারীরা বেকার নন, তারা স্বাবলম্বী।
একটু গভীরে যেতেই আমার প্রশ্নের উত্তর মেলে। কেন এত মেরামতের পরেও রাস্তা খালি ভাঙে আর ভাঙে! এই নারীদের সরাসরি কেউ পরিচালনা করছেন না। তারা নিজেরাই নিজেদের মতো করেই যাচ্ছেন।
মুখে পান চিবাচ্ছেন, দুঃখের সুখ্খের গল্প করছেন, আর কংক্রিট-বালু ঢেলে যাচ্ছেন। কোনো ইঞ্জিনিয়ারের এখানে থাকার দরকার নেই! এই অনভিজ্ঞ নারীদের হাতেই যখন একেকটি রাস্তা গড়ে ওঠে, সেটি ভাঙতে কতক্ষণ?
>> লেখক : সাংবাদিক, news.joynal@gmail.com