বিথী, জুনায়েদ এবং অসুস্থ দেশের গল্প

জয়নাল আবেদীন
Published : 16 March 2016, 03:44 AM
Updated : 16 March 2016, 03:44 AM

কদিন ধরে রিজার্ভ লোপাট ইস্যুতে যা ঝক্কি-ঝামেলা যাচ্ছে, তাতে মনের ভেতরে রিজার্ভ থাকা আইডিয়া বেরিয়ে যাবার উপক্রম। এর মধ্যে আবার ঢুকে গিয়েছিল ধানমণ্ডির 'ওয়ান ম্যান হিরো' জুনায়েদ। হিরোর গল্পটা একটু বলতেই হয়। সঙ্গে রিজার্ভ লুট সংক্রান্ত কিছু কথাও বলার বাকি। সবই শোনাবো। তার আগে অন্যগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আলোচনার আকাশে চড়তে না পারা ইস্যু নিয়ে কটা কথা।

বিথীরা বোধোয় বেঁচে থাকার জন্যে জন্মায় না! না, দেড় বছরের শিশুটি এখনো বেঁচে আছে। তবে মৃত্যুকে জয় করতে পারে কি না, সেই সংশয় থেকে যায়। ওর ঠিকানা এখন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ।

দুদিন ধরে একটি বীভৎস ছবি ভাসছে ফেসবুকের পাতায়। এমন ছবি যতই এড়িয়ে চলি, চোখের সামনে ভাসবেই! আমি এ ধরনের ছবি প্রকাশের ঘোর বিরোধী। এগুলো সহ্য ক্ষমতাকেও উতরে যায়। চোখ রাখা যায় না কোনমতেই।

ছবিটি দেখলে কারো বিশ্বাস হবে না যে বিথী এখনো বেঁচে আছে। দেশিয় একটি ছুরি কচি বাচ্চাটির কোমল পেটে ঢুকে বেরিয়েছে কোমর হয়ে!

হাসপাতাল থেকে বিথীর মা কী বলেছেন পড়ুন-

'শাহজাহান এসেছিল ছুরি হাতে, আমার স্বামীকে মারতে। তাকে না পেয়ে হঠাৎ করেই এক প্রতিবেশীর কোলে থাকা আমার ১৮ মাসের মেয়ে বিথীকে কেড়ে নেয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিথীর এক হাত ধরে শূন্যে ঝুলিয়ে পেটের মধ্যে ছুরি ঢুকিয়ে দেয়। ছুরিটি ওর পেট দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়। এ অবস্থায়ই বিথীকে ছুড়ে ফেলে শাহজাহান চলে যায়।'

এতটা নৃশংস যারা হতে পারে, তাদেরকে আমি অমানুষ বলছি না। ওদেরকে 'পশু' আখ্যা দিয়ে সত্যিকারের পশুর প্রতি অসম্মান জানাতেও চাই না। ওই নরপিশাচকে দেওয়ার মতো কোনো বিশেষণ আমার শব্দভাণ্ডারে নেই।

মানুষে মানুষে স্বার্থের দ্বন্দ্ব কতটা তিক্ত হলে শিশুরাই বলির পাঠা হতে পারে! উহ্। এই শিশুরাই মরে চলেছে কদিন ধরে। চারদিকে যেভাবে শিশুদের ওপর আক্রমণ চলছে, তাতে নিকট ভবিষ্যতে কোনো দম্পতি পৃথিবীতে তাদের সন্তান আনার ব্যাপারে পাঁচ-সাত ভাববেন!

একটি ভিডিওচিত্রে দেখলাম, নূর উল্যাহ নামে এক তরুণকে অনেকক্ষণ ধরে কিল-ঘুষি দিয়েই চলেছে তারই 'ঘনিষ্ঠ' বন্ধু জুনাইদ। একদিকে জুনাইদ মারছে, বকছে, গালি দিচ্ছে, নিজের তেজ দেখাচ্ছে; অন্যদিকে নূর উল্যাহ কেবল মার খেয়েই যাচ্ছে।

আরেক তরুণ মোবাইলের ক্যামেরায় দৃশ্যটি নীরবে ধারণ করে যাচ্ছে। গভীরে না গেলে মনে হবে কোনো নাটকের অংশবিশেষ ধারণ হচ্ছে বা মহড়া চলছে। জুনাইদের বান্ধবীকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করার জের ধরেই এই আক্রমণ।

অবস্থাদৃষ্টে নয়, ভেতরের কাহিনি খুঁজতে গিয়েই জানা গেলো- ওরা ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থী। যে মেয়েটি সম্পর্কে বাজে মন্তব্যের অভিযোগ ওই মেয়েটিও একই মাধ্যমে পড়ে। ঘটনাক্রমে ওই মেয়েটির একটি বাজে ছবিও চোখে পড়ে গেলো।

ইংরেজি মাধ্যমের ছেলে-মেয়েগুলো বখে যায়- এই সাধারণ ধারণাটি আরো পোক্ত হলো। পশ্চিমা সংস্কৃতি অনুকরণ করতে গিয়ে ওরা কেবল ইংরেজিটা শিখছে না, ন্যূনতম রুচিটাও হারিয়ে ফেলেছে।

জুনাইদ এখনো ধরা পড়েনি। এই তরুণ কতটা বিকারগ্রস্ত সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বখাটেপনার সর্বোচ্চ মাত্রা অতিক্রম করেছে। ওকে ধরতে পারলে সম্ভবত নতুন নতুন বহু তথ্য বেরোবে। ইংরেজি মাধ্যমের ধনীর দুলাল-দুলালিরা ঢাকাকে কতটা অতলে নামিয়েছে, কতটা অন্ধকারে ফেলতে চাইছে, সেসব বের হতে পারে। আমি কিছু অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছি। আমার মনে হয়েছে- এই বখাটে তরুণকে ধরতে পারলে সেখান থেকে ঢাকার অন্ধকার জগতটা জানা যাবে।

দুদিন আগে আমরা স্কুলছাত্রী শতাব্দীর গল্প শুনেছি। 'মিনিস্টার ওবায়দুল কাদের, আই হ্যাভ অ্যা কোয়েশ্চেন'- এই একটি বাক্য বলে মন্ত্রীর নজরে আসার মতো পাটা কজনের বুকে আছে? সম্ভবত নেই।

নইলে গতকাল কোনো সাংবাদিক অর্থমন্ত্রীকে এ ধরনের সম্বোধন করে বিশেষ কিছু প্রশ্ন করার সুযোগ নিতে পারলেন না কেন? কেউ একজন বলতে পারলেন না কেন- মিনিস্টার মুহিত, আই হেভ অ্য স্পেশাল কোয়েশ্চেন?

সেই বিশেষ প্রশ্নটি হতে পারত- আপনি চার হাজার কোটি টাকার কেলেংকারি নিয়ে যতটা দৌঁড়াননি, ৮০০ কোটির বেলায় এত ক্ষুব্ধ কেন? হলমার্ক, ডেসটিনি, সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংকের বেলায় কেন এতটা তৎপর হননি? শেয়ার বাজার কেলেংকারির মতো এত বড় ঘটনায় কেন কারো ওপর এতটা চড়াও হতে পারেননি, যতটা হয়েছেন ড. আতিউর রহমানের ওপর?

রিজার্ভ লুটের কিছু অর্থ পাওয়া গেছে- সেটা পুরনো খবর। নতুন খবর হলো- বাকি টাকা পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই বললেই চলে। যে টাকা গেছে, সেটা হয়তো আমাদের মোট রিজার্ভের বিপরীতে একেবারেই 'নগণ্য'।

কিন্তু চোর যখন বাড়ি চিনে গেছে, সেটা মাথায় রেখে তালা-চাবিগুলো মেরামত করা সময়ের দাবি। এ ছাড়া ঘরে পোষা যে ইঁদুরগুলো গুণপোকা হয়ে ঘাপটি মেরে আছে, আমাদেরকে অন্ধকারে রেখে আমাদেরই ঘরের বেড়া কাটছে সেই প্রাণীদের ধরতে হবে। যে ১৫ জনকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে, তারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে!

গভর্নরের পদত্যাগ, দুই ডেপুটিকে অব্যাহতি, একজন আমলাকে ওএসডি স্থায়ী সমাধান নয়। থানায় মামলা হয়েছে। আশা করি, মামলার রেফারেন্স ধরেই সম্পৃক্তদের আটক করা হবে। প্রথমে সব নাটের গুরুর মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। তারপর বাকি কাজ…

বাকি কাজ বলতে যা বলছি-

বিথীর পেটে চুরি ঢুকিয়ে পালিয়ে আছে যে নরপিচাশ, ধানমন্ডির 'ওয়ান ম্যান হিরো' এবং আমাদের বেড়া কাটছে যেসব ইঁদুর- এই তিনটা শ্রেণিকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে এমন কিছু করতে হবে, যেন অন্তত এক মুহূর্তের জন্যে হলেও আমাদের হৃদয়টা কেঁপে ওঠে। এটা ছাড়া উত্তম ওষুধ আর নেই তো! ওদের সত্যিকারের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এখন সময়ের দাবি।

১৮ মাসের শিশু বিথী সতেজ ফুলের মতই নিষ্পাপ-পবিত্র। পরম করুণাময়ের কাছে আকুল প্রার্থনা- এই ফুলটি ফুটিয়ে দাও তোমার করুণা দিয়ে।

লেখক : সাংবাদিক, news.joynal@gmail.com