অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত প্রথমে বললেন- নিজের কথা নিজের বলা উচিত না।
এরপরই বললেন- বাজেট ব্যবস্থাপনায় গত সাত বছরে আমি যা করেছি, এ ব্যাপারে এই মুহূর্তে আমার চেয়ে বিশেষজ্ঞ দ্বিতীয় ব্যক্তি পৃথিবীতে নেই।
তাঁকে প্রশ্ন করা হলো- আপনি কিন্তু বলেছিলেন বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন, পরে আর নেননি।
অর্থমন্ত্রী বলেন- হ্যাঁ, বলেছিলাম। ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এখনো হয়নি। যাই হোক। রাজনৈতিক ব্যাপার-স্যাপার সব আলাপ করা যায় না…।
পদত্যাগী গভর্নর ড. আতিউর রহমানের অর্জন শূন্য দাবি করে অর্থমন্ত্রী বলেন, তিনি (আতিউর) খালি পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়েছেন আর লোকজনকে অনুরোধ করেছেন বক্তৃতা দেওয়ার জন্য তাঁকে সুযোগ দিতে ও দাওয়াত দিতে।
সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্যও প্রকাশ করলেন মন্ত্রী- 'বাংলাদেশ ব্যাংকের নিচতলায় যে লেনদেন হয়, তার মুনাফার কোনো হিসাব থাকে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের লোকেরা ভাগ করে নিয়ে যান।'
পৃথিবীর অদ্বিতীয় বাজেট বিশেষজ্ঞ দাবিকারী এই অর্থমন্ত্রী এটিও স্বীকার করেছেন যে, গতবার বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। এই ব্যর্থতাও তাঁর নয়, এনবিআর চেয়ারম্যানের।
অর্থমন্ত্রী বলেন, 'এনবিআরের চেয়ারম্যান কোনো কাজ-কাম করেন না। কিছুই করেন না তিনি। খালি বক্তৃতা দেন…। এক বছর হয়ে গেছে, অথচ এনবিআরের চেয়ারম্যান জানেনই না যে এনবিআর কীভাবে চলে।'
অর্থমন্ত্রী একটি বিষয় স্পষ্ট করেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ছয়জন লোকের হাতের ছাপ ও বায়োমেট্রিকস ফেডারেল রিজার্ভে আছে। নিয়ম হলো, প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়— এভাবে ষষ্ঠ ব্যক্তি পর্যন্ত নির্দিষ্ট প্লেটে হাত রাখার পর লেনদেনের আদেশ কার্যকর হবে।
তার মানে রিজার্ভের টাকা তুলতে হলে এই ছয়জনের হাতের ছাপ বাধ্যতামূলক। সেই ছয়জন কারা, সেটা তো তাঁর জানার কথা নয়। তাহলে এদেরকে পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছেন না কেন অর্থমন্ত্রী?
তাঁর ভাষায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক লোক এই জালিয়াতির ঘটনায় জড়িত। আতিউর রহমানের বিগত সাত বছরের অভিযোগ জমা করে তিনি পাহাড় গড়েছেন, অথচ এই সময় ধরে তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি। এর দায় অর্থমন্ত্রীর নয়?
মোদ্দা কথা হলো, অর্থমন্ত্রীর চোখে অনেক অপরাধী। কিন্তু আমরা কোন পক্ষকে বিশ্বাস করবো? স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীই তো বলেছেন, আতিউর রহমানের আমলে দেশের অর্থনীতি প্রাণ পেয়েছে।
অর্থমন্ত্রীর অভিযোগগুলো সত্য হলে, সব দুর্নীতিবাজ আমলা-কর্মকর্তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হোক। আর যদি মিথ্যা হয়, তাহলে অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
একটি কাগজে প্রকাশিত অর্থমন্ত্রীর সাক্ষাতকারে বহু স্পর্শকাতর তথ্য বেরিয়েছে। তাতেও চটে গেলেন তিনি! তাঁর দাবি, এর আগে অর্থমন্ত্রী যত সাক্ষাতকার ছাপানো হয়েছে, সবগুলোই 'অনুমোদিত'। কারো সাক্ষাতকারও অনুমোদন সাপেক্ষে ছাপানোর নিয়ম আছে কি না আমার জানা নেই।
অনুমোদন বলতে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, সাক্ষাতকারের প্রশ্ন এবং উত্তর পর্যায়ক্রমে তুলে ধরে সাংবাদিক সাহেব আগে একটি খসড়া লিখবেন। এরপর মন্ত্রী সেটা পড়ে দেখবেন। কোথাও 'অসঙ্গতি' চোখে পড়লে সেটা বিয়োজন এবং তাঁকে ওপরে তোলার জায়গায় ঘাটতি থাকলে নিজের মতো সংযোজন করাকেই হয়তো অনুমোদন বলা হয়! এরপর সেটি ছাপার যোগ্য হবে সংবাদপত্রে। সাক্ষাতকার প্রকাশ নিয়ে এর আগে এমন অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া অন্য কেউ দেখিয়েছিলেন কি না জানা নেই।
অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, রিজার্ভ লোপাট একটি বড় ঘটনা। ঠিক বলেছেন। এটা নিয়ে মানুষের অনেক আগ্রহ। অথচ এটি নিয়ে তিনি মানুষের সঙ্গে বেশ লুকোচুরিতে মেতেছেন। তাঁর উচিত, টাইম টু টাইম পরিস্থিতিটা মানুষকে জানানো।
অথচ তাঁর মুখ থেকে কথা বের করাই কঠিন! দুজন ডেপুটি গভর্নরকে সরিয়ে দেওয়া হলো। সেই নাম দুটো নিজের মুখে বলতেও তিনি দ্বিধা করেন। অথচ এখন বড় গলায় অমুক-তমুকের নাম ধরে ধরে নানা রকমের অভিযোগ তুলছেন।
আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের ওই একটি কথা ফেলে দেওয়া যায় না- রাবিশ, খবিশ…
আসলেই তো। বাংলাদেশের কোনো মন্ত্রী বাংলাদেশিদের সঙ্গে ইংরেজি বলে বেড়াবেন কেন? মন্ত্রীর বাংলাপ্রেমের এই যদি হয় অবস্থা, আবুল কালামের দোষ কোথায়? তাঁর রুচিবোধ নিয়ে তোলা প্রশ্নটি যথার্থই।
অর্থমন্ত্রী দাবি করেছেন, আতিউর রহমানকে তিনিই নিয়োগ দিয়েছিলেন। তাহলে কী আমরা ধরে নিবো- নিজের নিয়োগ করা গভর্নর বলেই হাজারো অভিযোগ শুনেও ব্যবস্থা নেননি অর্থমন্ত্রী? আবার তাঁকে টপকে প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ হওয়াটাই কী আতিউরের জন্য কাল হলো?
লেখক : সাংবাদিক, news.joynal@gmail.com