পূজার আলো নিভিয়ে দেওয়া এক অন্ধকারের গল্প

জয়নাল আবেদীন
Published : 8 April 2016, 07:33 PM
Updated : 8 April 2016, 07:33 PM

বার্ণ ইউনিটের বাতাসে কেবল পোড়া গন্ধ না, আছে বুকফাটা আর্তনাদও। দেহের ভেতরে পুড়ে গেলে বাঁচার আকুতি কতটা করুণ, সেটি উপলব্ধি করেছি বৃহস্পতিবার বিকেলে।

বার্ণ ইউনিটে ঢুকতেই নওশাদ ইশতিয়াক হৃদয়ের মুখটা দেখা গেলো। লুঙ্গি পরে শুয়ে থাকা ছেলেটির ডান পা পুড়ে লাল! গলা থেকে বুক পর্যন্ত পোড়া দাগ। সহানুভূতিশীল মানুষের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা পেয়ে পোড়া হৃদয় জিতে গেলো।

আরেকটু ভেতরে ঢুকলে ২৬ নাম্বার ওয়ার্ড। সামনে যেতেই পূজা নামে এক কিশোরীর আর্তনাদ- আমাকে বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও…। তাকে ঘিরে মাথার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন কিছু মানুষ। শুনে যাওয়া ছাড়া ওই কিশোরীর করুণ আহ্বানে সাড়া দেওয়ার মতো শব্দ কারো মুখে নেই।

২৫ দিনের ক্ষত শুকিয়ে ধীরলয়ে হাঁটতে পারে হৃদয়। মায়ের পিছু পিছু সেও এগিয়ে আসে ২৬ নাম্বার ওয়ার্ডের দিকে। পূজার মুখের দিকে তাকিয়ে সেকেন্ডের মধ্যেই মায়ের বুকে মুখ লুকায় হৃদয়। ওর চোখেমুখে স্পষ্ট হয়ে ওঠে ভয়-আতংক!

পোড়া হৃদয় কেন, পূজার মুখটা দেখে অপলক দৃষ্টিতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না কেউই। বার্ণের ভাষায় হয়তো মেয়েটি ৬০ শতাংশ পুড়েছে। অথচ ওর যে কী ভয়ংকর অবস্থা, তা কোনো করুণ শব্দ দিয়েই বর্ণনা করা অসম্ভব!

আমিও এক মুহূর্তের বেশি তাকিয়ে থাকতে পারিনি। ওর মাথার পাশে দুই মিনিট নীরবে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সে শুধু একটি আর্তনাদই করছিল- আমাকে বাঁচাও, মা আমাকে বাঁচাও…

মিরসরাই পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে পূজা রাণী শীল। চৌদ্দ বছরের মেয়েটি কখনো বাবার মুখ দেখেনি। সে যখন মায়ের পেটে পাষণ্ড বাবা তাদের ছেড়ে চলে যায় আগরতলায়। মেয়ে যখন পৃথিবীর মুখ দেখে, এরপর একদিন চিঠি আসে। বাবা লিখেছিলেন, পূজার টানে ফিরে আসবেন। আর আসলেন না।

একমাত্র সন্তানকে বুকের মধ্যে আগলে রেখে ভাইয়ের কাছেই আশ্রয় খোঁজেন রীনা রাণী শীল। বাবা নেই। রানীর ভাই অরুণের ছোট্ট একটি সেলুনের দোকান। এই নরসুন্দর শুধু মানুষের চেহারা নয়, সুন্দর করে গড়ে দিতে চেয়েছিলেন ভাগ্নির জীবনটাও।

আশা ছিলো, ভাগ্নিকে এসএসসি পাশ করাবেন। এরপর ভর্তি করে দেবেন মিরসরাই কলেজে। মানুষ করে দেবেন পড়াশোনা শিখিয়ে। কখনো বাবার শূন্যতা বুঝতে দেননি। অনেক অভাবের সংসারেও কষ্ট ছিলো না। এরপর তাদের সমস্ত গতিকে থমকে দেয় এক অন্ধকার রাত। তছনছ হয়ে যায় সাজানো সংসার।

৫ এপ্রিল রাত নয়টার ঘটনা।

পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত পূজা। লোডশেডিং শুরু হলে বাতি জ্বালায় সে। এরপর দেখে চেরাগও নিভুনিভু। কেরোসিন ঢালতে যায়। কেরোসিন চেরাগের ভেতরে গেলো না, পড়ে গেলো আগুনে। অমনি দাউ দাউ আগুনে ঝলসে যেতে থাকে পূজার সমস্ত শরীর।

সে-ই শুরু কষ্টের কাহিনি।

মাতৃকা হাসপাতাল ঘুরে বার্ণ ইউনিটে ঠাঁই হয় পূজার। কিন্তু পোড়া যন্ত্রণা আর কমে না। মুখ, ঘাড়, গলা, বুক, দুই হাত, দুই পায়ের কোনো অংশই বাদ যায়নি। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে মাথার সব চুল।

নিকটস্থ স্বজনদের হাতে যা ছিলো, তাতেই এই পর্যন্ত চিকিৎসার খরচ মিটিয়েছেন অরুন। এখন সহায় বলতে আর কিছুই নেই। আছে দুটো বিকাশ নাম্বার আর একটি ব্যাংক হিসাব। কষ্টের এই গল্প আপনার হৃদয় ছুঁয়ে গেলে ওদের পাশে দাঁড়ান।

বিকাশ নাম্বার- ০১৮১৮৯৮৯২৩৬ * ব্যাংক হিসাব নাম্বার- রিনা রানী শীল, ০০৯১৩৪০১২৯৪৪ ন্যাশনাল ব্যাংক, মিরসরাই শাখা, চট্টগ্রাম।

আমার কানে এখনো সেই করুণ আর্তনাদটিই বাজে- আমাকে বাঁচাও, মা আমাকে বাঁচাও…

আর চোখে ভাসে শুধু্ একটি দৃশ্য। পোড়া হৃদয় এক পা দু পা করে এগিয়ে যে-ই ২৬ নাম্বার বেডের নিকটে গেলো, অমনি মুখটা লুকিয়ে নিলো মায়ের বুকে। পূজার পোড়া মুখটা সে সইতে পারেনি।

এক দগ্ধ কিশোরীর ক্ষত-বিক্ষত চামড়া সইতে পারেনি আরেক ছোট্ট পোড়া হৃদয়। আমরা অক্ষত হৃদয় দিয়ে কী করে পূজার যন্ত্রণাময়ী করুণ আর্তনাদ সইবো? পূজা এখন জীবন-মরণ লড়াইয়ে। তার পরিণতি ঠিক হয়ে যাবে আমার-আপনার সিদ্ধান্তের ওপর।

বলুন, কোন সিদ্ধান্ত নেব আমরা? পূজার পরিণতি কী?

লেখক : সাংবাদিক, news.joynal@gmail.com

01814318532