এই নিষ্ঠুর জীবনালেখ্য এক মধ্যবয়সী নারীর

জয়নাল আবেদীন
Published : 2 May 2016, 01:52 AM
Updated : 2 May 2016, 01:52 AM

এই গল্প এক মধ্যবয়সী নারীর; যাঁর জীবনের বাঁকে বাঁকে শুধুই ট্র্যাজেডি আর ট্র্যাজেডি। যে বয়সে স্বামী, সন্তান আর সংসার নিয়ে সুখে সময় কাটানোর কথা, সে বয়সে লিপি আক্তারের জীবনই অনিশ্চয়তার ঘেরাটোপে। বয়স ৩৫ ছুঁইছুঁই। অথচ বৃদ্ধা মাকে নিয়ে তার সংগ্রামী জীবন আজ অস্তাচলে!

লিপি এমন এক সংগ্রামী নারীর প্রতিকৃতি, যিনি বহু দুর্গম পথ পাড়ি দিতে গিয়ে অজেয়কে জয় করেছেন অনায়াসে। ৬০ বছরের বৃদ্ধা মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে বিসর্জন দিয়েছেন নিজের সমস্ত সুখস্বপ্ন। এই অদম্য নারীর জীবনভর বয়ে চলা কষ্টগুলো হৃদয় ছুঁয়ে যায়। আমি ঠিক সেভাবে লিখতে পারছি না, যেভাবে একের পর এক ঘটে গেছে মর্মস্পর্শী ঘটনাগুলো। মাকে দিয়ে শুরু হওয়া ট্র্যাজেডি শেষ হয় মেয়ে লিপি আক্তারকে দিয়ে। মা-মেয়ের জীবনের পরতে পরতে শুধুই দুঃখ।

ওদের সংগ্রামী জীবনের কাছে নিয়তিই যখন পরাস্থ, তখন আঘাত হয়ে এলো নীরব ঘাতক ক্যান্সার। ক্যান্সারের সঙ্গেই এখন লিপির যুদ্ধ। নিয়তির এমন এক নির্মমতা, একটি প্রাণের ওপরই বেঁচে আছে দুটো জীবন। লিপির জন্য আজ জীবন সায়াহ্নে এসে আবারও অমানিশার অন্ধকারে বৃদ্ধা মায়ের জীবন। পৃথিবীতে বেঁচে থাকা মানবতাই পারে একসঙ্গে দুটো জীবনে আলো ফোটাতে।

কোলন ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়ার যে মানসিকতা লিপির ভেতরে, সেটি অনেকের থাকে না। তিনি কেবল এই একটি কথাই বলেন, 'নিজেকে নিয়ে আমার কোনো স্বপ্ন নেই, বেঁচে থাকার ইচ্ছে শুধুই মায়ের জন্য। এই মা জন্মের দ্বিতীয় বছর থেকেই এতিম, অনেক কষ্ট করেছেন।'

কষ্টের ইতিহাস হাতড়ে বেড়ালে বেরিয়ে আসে, মাত্র দুই বছর বয়সে বাবা-মাকে হারান রোজিয়া। বহু কষ্টের শৈশব-কৈশর পেরিয়ে যান স্বামীর ঘরে। কোলজুড়ে আসে একটি ছেলে। তারপর আরেক সন্তান যখন পেটে, তখনই চিরতরে নিভে যান স্বামী। দুটো ছেলে-মেয়েকে মানুষ করতে নিজেই নেমে পড়েন জীবনযুদ্ধে। ছেলে বড় হলে সাময়িক মুক্তি মেলে মায়ের। অভাব যতই থাকুক, ওদের জীবনের গল্পটা তখনো ঠিকই ছিলো।

কিন্তু তাঁর নিয়তি যে ট্র্যাজেডি লেখা! একদিন মায়ের পৃথিবী অন্ধকার করে নিভে যায় ছেলের চোখের আলো। ক্যান্সারের কাছে হেরে যায় ছেলেটি। মেয়েকে নিয়ে রোজিয়া পড়ে যান গভীর দুঃখের সমুদ্রে। সেখান থেকে কূলের দেখা পাচ্ছিলেন না। সংগ্রামী মায়ের যুদ্ধটা আবার শুরু।

সেই যুদ্ধেও টিকতে পারলেন না বেশিকাল। মা আর লিপির জীবনটা তখনই ঢেকে যায় অন্ধকারে। সেখান থেকে আলোর সন্ধানে পথে নামেন বাবার মুখ না দেখা সেই ১৭ বছরের কিশোরী লিপি। মাত্র ৮০০ টাকা বেতনেই ঢুকে পড়েন একটি পোশাক কারখানায়। মাকে সঙ্গে নিয়ে বসবাস শুরু করেন চট্টগ্রাম নগরীতে।

সেই রোজিয়া এখন ৫৮ বছরের এক নুয়েপড়া বৃক্ষ। জীবনের এই প্রান্তে এসে আরো একবার তিনি পরাজিত। এবার তিনি একা নন, সঙ্গে তাঁর মেয়ে লিপিও! ৮০০ টাকায় শুরু করা চাকরির মূল্য যখন ১২ হাজারে উত্তীর্ণ, তখন তিনি মাকে নিয়ে দেখতেই পারেন সুখী পৃথিবীর স্বপ্ন।

না!

স্বপ্নটা তছনছ হয়ে গেলো এখানেই। পায়ূপথ হয়ে রক্তক্ষরণ দেখে গিয়েছিলেন হাসপাতালে। ডাক্তার যে তাঁর মাথার ওপর এত কঠিন দুঃস্বপ্নের ঘণ্টা বাজিয়ে দেবেন ভাবতেই পারেননি। বাবা-ভাই-স্বামী নেই। কোনো অভিভাবকও নেই। সে অবস্থায় ডাক্তার সরাসরি লিপিকেই বলে দিলেন- তোমার ক্যান্সার।

একদম একা মেয়েটি ধন্ধে পড়ে যান। তিনি কী করবেন? নিজের জন্য নয়, ভাবনাটি মায়ের জন্য। লিপি কার কাছে যেন শুনেছেন, কারো কারো সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অজেয়কে জয় করা যায়। এক এক করে বলতে থাকেন জীবনের পরতে পরতে মিশে থাকা দুঃখগুলো।

মাকে ঘিরেই তাঁর যত দীর্ঘশ্বাস। লিপি বলেন, ‌'আমি চলে গেলে মায়ের কী হবে?' যেই মেয়েটি মাকে সুখী করতে নিজের সমস্ত সুখস্বপ্ন কবর দিয়েছেন, তিনি এই পর্যায়ে এসে কী করে এই ব্যাথা সইবেন? ভালোমত খেতে পারেন না। পেটে একটু খাবার পড়লেই শুরু হয় তীব্র ব্যাথা। কষ্টে-যন্ত্রণায় চাকরিটাই ছেড়ে দিলেন।

চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার তারাকাটিয়া গ্রামে তাদের বাড়ি। খুব দ্রুত অপারেশন বাধ্যতামূলক হলেও তিনি পড়ে আছেন বাসায়। সামান্য কিছু টাকা হাতে পেলেই তাঁর চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব। প্রেসক্রিপশন এবং ক্লিনিক্যাল কাগজপত্র একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দেখালাম। লিপি কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত। প্রেসক্রিপশনে স্পষ্ট লেখা আছে- অপারেশন করতে হবে যতটা দ্রুত সম্ভব। এরপর দিতে হবে কেমো থেরাপি। আপাতত অপারেশনের জন্য দরকার দেড় লাখ টাকা।

প্রথমত, অন্ততপক্ষে দেড় লাখ টাকা জোগাড় করতে চাই। এটা করতে পারলে লিপিকে বাঁচানোর একটি ভরসা পেতে পারি। প্রথমে একটি অস্ত্রোপচার জরুরি। যত দ্রুত সম্ভব এটা করতে হবে। এরপর পরিবর্তিত পরিস্থিতি অনুযায়ী চিকিৎসা শুরু হবে।

ক্যান্সার শুনেই আমি ঘাবড়ে যাই। সাদামাটা ধারণা হলো, ক্যান্সার মানেই নীরব ঘাতক। তিলে তিলে ক্ষয়ই যার পরিণতি। অথচ লিপির সঙ্গে কথা বলে একটিবারের জন্যেও মনে হলো না যে তিনি মৃত্যুশংকায়! বুকভরা মনোবল নিয়ে তিনি বাঁচতেই চান। নিজের জন্য নয়, শুধুই মায়ের জন্য।

লিপির মনের ভেতরে যে বিশ্বাস খেলা করে, তাতে তিনি ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়ে জিতবেন বলেই আমার আশা। কষ্টের কাহিনি বলার সময় তার গলা ভার হয়ে আসে, চোখ ভিজে যায় বটে, আশাটা পুষে রেখেছেন ঠিকই। জোরালো বিশ্বাস, ক্যান্সার-জয় তিনি করবেনই।

মে দিবস গেলো কাল। আমরা শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অনেকেই ব্যস্ত দিন কাটিয়েছি। কী হবে তাতে? একজন আজন্মের শ্রমিক লিপি। এই মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়েই তো আমার তাবৎ পৃথিবীর শ্রমিকদের ওপর সম্মান দেখাতে পারি। একজন মানুষ অবহেলায় মারা গেলে আমরা মিছিলে নামি। বিক্ষোভে ভাঙচুর করি। যখন ওই মানুষটি মরতে বসেন, তখন কেন খবর নিই না? সেই প্রেক্ষাপটটা বদলে যাক আমাদের হাত ধরে। আমরা আবারও প্রমাণ করতে চাই, মানুষের জন্যই মানুষ।

লিপির করুণ আরজি কানে এলে যে কোনো মানবদরদী মানুষের অন্তর ভিজে যাবে। মা ছাড়া কেউই নেই এই দুঃখিনীর। মায়ের কথা ভেবে তিনি বিয়ে পর্যন্ত করেননি। বৃদ্ধা মায়ের মুখে অন্ন জোগাতে যে মেয়েটি একলা একাই লড়ে যাচ্ছেন, তাঁকে জিতিয়ে দিতে পারি আমরাই। এখন তিনি চেয়ে আছেন আপনাদের দিকে, যদি একটু আশা দেখান কেউ- সেই ভরসায়।

এই সমাজের মানবতাবাদি মানুষেরা এগিয়ে এলে আরেকটি সংগ্রাম শুরু করা যায়। আমরা জানি না এই যুদ্ধে জিতব কি না। তবে লিপির চাঙা মনোবলই এমন একটি যুদ্ধজয়ের প্রেরণা জোগায়। একজন মানুষের বাঁচার আর্তনাদ শুনে আর চুপ করে থাকা যায় না। প্রত্যেক বিবেকবান মানুষ আওয়াজ তুলুন। ওপরওয়ালার কাছে ফরিয়াদ করুন, যেন লিপির এই সংগ্রাম সফলভাবে শেষ হয়। তবে শুরুতে তিনি পাশে চেয়েছেন আপনাদের সবাইকে। ভাই কিংবা বোন হয়ে বাড়িয়ে দিন আপনার হাত। লিপি বাঁচবেই।

বিকাশ অ্যাকাউন্ট নাম্বার : 01913 42 17 39   &   01682 76 20 44

[অনুদান এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত যে কোনো তথ্যের জন্য লেখকের ফেসবুক আইডির ইনবক্সেও যোগাযোগ করতে পারেন : https://www.facebook.com/joinalabedinbd ]

লেখক : সাংবাদিক, news.joynal@gmail.com, 01814 31 85 32