বরিশাল যেন আজো সেই চন্দ্রদ্বীপ

জয়নাল আবেদীন
Published : 30 Nov 2016, 02:15 AM
Updated : 30 Nov 2016, 02:15 AM

বরিশালের এক জেলা থেকে অন্য জেলায় আসামি স্থানান্তরের বড় মাধ্যম হলো লোকাল বাস

বরিশাল শহরের রুপাতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে ঝালকাঠির বাসে উঠে বসলাম। ততক্ষণে কোন আসন খালি তো নেই-ই, বরং বেশ কয়েকজন যাত্রী দাঁড়িয়ে। বাস ছাড়ার আগে হুড়মুড় করে উঠে গেলেন খাকি পরিহিত চারজন পুলিশ সদস্য। সঙ্গে বিশেষ একজন। দু'হাতে কড়া লাগানো। দু'পায়ে ডান্ডাবেড়ি। সঙ্গে পুলিশ, আর ডান্ডাবেড়ির আওয়াজ- বুঝে নিলাম বিশেষ ব্যক্তি আর কেউ নন, আসামি।

যাত্রীবাহী বাসে আসামি বয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটি আমার কাছে চিরচেনা। নিজের এলাকা মিরসরাইয়েও এ রকমটা দেখেছি। চট্টগ্রামের আদালতে আসামি নেওয়া হতো যাত্রীবাহী বাসে করেই। 'বরিশাল টু ঝালকাঠি' বাসে করে যাকে নেওয়া হচ্ছিলো, পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিলো তিনি গুরুতর কোনো আসামি। নইলে লোকাল বাসই যখন তাদের বাহন, সেক্ষেত্রে যাতায়াতের সুবিধার কথা চিন্তা করে আসামিকে অন্তত ডান্ডাবেড়ি পরানোর কথা নয়।

পুলিশ দেখেই আমার সামনের সিটের এক ভদ্রলোক নিজের আসন ছেড়ে দাঁড়ালেন। চার পুলিশ সদস্যের মধ্যে একজন একটু বয়স্ক। তিনি নিজে না বসে বসতে বললেন আসামিকেই! একটু আগেই ডান্ডাবেড়ি লাগানো আসামিকে লোকাল বাসে যাতনার মধ্য দিয়ে বয়ে নেওয়ার যে মৃদু ক্ষোভ মনে জন্ম নিয়েছিলো, মুহূর্তেই সেই অনুভূতি পাল্টে গেলো। ওই পুলিশ সদস্যের মানবিকতা দেখে। শেষপর্যন্ত আসামি নিজেই বসলেন।

ঝালকাঠি সদরে বাস পৌঁছালে আসামিকে নিয়ে নামেন পুলিশের সদস্যরা। এই নিয়ে তাদের বদলাতে হয় তিনটি বাস!

সড়কপথে বরিশাল শহর থেকে ঝালকাঠি জেলা সদরের দূরত্ব সতের কিলোমিটার। লোকাল বাসে সময় লাগে ২০ থেকে ৩০ মিনিট। এই সময়ের মধ্যেই আসামির সঙ্গে একটি মিনি-সাক্ষাতকার হয়ে গেলো। যাকে গুরুতর আসামি ভেবে রেখেছি, প্রথম প্রশ্নেই বিস্ময় উপহার দিলেন তিনি! নিজের স্ত্রী একটি সাধারণ অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। তিনি ধরা দিচ্ছিলেন না বলে। অবশেষে ধরা পড়লেন পুলিশের হাতে। তাতে হয়তো বউয়ের কিছু টাকা আর সময় গেলো। কিন্তু স্বামীকে তো পেলেন।

সেই সাক্ষাতকারের পরবর্তী ধাপগুলোর দিকে নাই বা গেলাম। অবাক হয়েছি সেখানেই- নিজেদের বাহন নেই। তাহলে এত ঠুনকো অভিযোগের প্রেক্ষিতে কোনো আসামিকে যখন লোকাল বাসেই নেওয়া হবে, তখন পায়ে ডান্ডাবেড়িটা না লাগালে হতো না! পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, সাইফুল নামের আসামিকে নিয়ে তাদের যাত্রা শুরু হয় সেই পিরোজপুর থেকে। এই ঝালকাঠি নাগাদ পৌঁছাতে বদলাতে হয়েছে তিন তিনটে বাস!

ঝালকাঠি সদরে লোকাল বাস থেকে নামার পরে তারা যাচ্ছিলেন অটোর দিকে। তিনটি বাস বদলানোর পরে সর্বশেষ অটোতে করে যাবেন আদালত পর্যন্ত

ধৃত সাইফুলকে পুলিশি স্থানান্তরের এই চিত্র বরিশালের সামগ্রিক অবস্থা বোঝাতেই যথেষ্ঠ নয়। বরিশালের পরিস্থিতি এর চেয়ে জঘণ্য। এই শহরের দিনরাত্রি সামনে থেকে যতক্ষণ দেখেছি, মনে হয়েছে এ আমার দেশ নয়। ভিন্ন কোনো জগত! ডিজিটাল বাংলাদেশ- স্লোগান ধারণ করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দল ক্ষমতায় আছে টানা আট বছর। অথচ সিটি করপোরেশন সত্ত্বেও বরিশালকে দেখে মনে হয়েছে মফস্বলের অবহেলিত কোনো অন্ধকার হাট! এই 'হাটে' সন্ধ্যা হলেই নেমে আসে অন্ধকার। সদর রোড হয়ে হাঁটছিলাম। সড়কবাতি একটি জ্বলছে তো পরবর্তী নয়টির চোখ বন্ধ!

পদ্মা সেতুর পিলার দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। দাঁড়িয়ে যাচ্ছে স্বপ্ন। দেশের দক্ষিণাঞ্চল এমনকি পশ্চিমাঞ্চলও যুক্ত হচ্ছে ঢাকার সঙ্গে। প্রশ্ন উঠতে পারে- তবে কী এতকাল এই দুটো অঞ্চল রাজধানী থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলো? আসলে অনেকটা বিচ্ছিন্নই বলা চলে। এপারের বাংলাদেশ আর ওপারের বাংলাদেশের মধ্যেই যে কত পার্থক্য। সেটি শুধু বাস্তবতায় নয়, ভাবনায়ও। এই ভাবনার ফারাক সরকারের, এমনকি দু'পারের অধিবাসীদেরও। পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে দু'পারের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থায় সেতুবন্ধন রচিত হবে।

মনের বন্ধনও রচিত হওয়া জরুরি। শুধু পথের দূরত্ব কমলেই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে দেশের মূলধারার ভাববার অবকাশ নেই; যতক্ষণ না সেখানকার জীবনযাত্রা এবং পরিবেশের মানোন্নয়ন ঘটছে। এই দুটো বিষয় একই সুতোয় গাঁথা। মানে একটি পূরণ হলে অন্যটি হয়েই যাবে। বরিশালের শহর এবং গ্রামাঞ্চল ঘুরে দেখেছি, মানুষের মধ্যে আধুনিকায়নের লেশমাত্র নেই। উন্নয়ন নিয়ে তাঁরা ভাবেন না। যে যার মতো অন্ন-বস্ত্রের ব্যবস্থা করতে পারলেই শেষ। দিন যায়, রাত নামে। আবার সকাল হয়। চক্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চাহিদামাফিক রোজগারটা চলছে। এই তাদের জীবন। যেন হাজার বছর ধরে চলমান জীবন কোন একটা জায়গায় আটকে আছে। অথচ সেখান থেকে বের হতে পারছেন না তারা।

এলোমেলো বরিশাল শহর

চলতে চলতে কথা বললাম রিকশাচালক আবুল খায়েরের সঙ্গে। বললাম- শহরের রাস্তাঘাট ভাঙা, এটা নিয়ে আপনাদের মনে কোন ক্ষোভ নেই, দুঃখ নেই? তাঁর সরল জবাব- 'মোগো পেটে ভাত গেলেই অইলো বাজান'। রাস্তা ভাঙা বিধায় যাত্রী নিয়ে টানতে একটুখানি কষ্ট হয় খায়েরদের। তাতে কী! গন্তব্যস্থলে গেলে যে ভাড়াটা পাচ্ছেন, সেটি তো ভাঙাচোরা নয়। তা দিয়েই যখন জীবন চলে যায়, রাস্তার চিন্তা মাথা ভার করে আর কী হবে!

সন্ধ্যা নামতেই অন্ধকার বরিশাল সিটি করপোরেশন

ছোট্ট একটি শহর বরিশাল। সিটি করপোরেশন হওয়া সত্ত্বেও সাদাচোখে যে চিত্র দেখেছি, সেগুলো পয়েন্টাকারে তুলে ধরলে অনেক কথা। সংক্ষেপে সমস্যার কথা তুলতে গেলে- একটি সড়ক বাদে আর কোনটিতেই বিভাজন (ডিভাইডার) দেখিনি। যান ও জন চলাচলে বিশৃঙ্খলা। রাস্তাঘাট এবড়োখেবড়ো। রাতের শহরটা একদমই ভূতুড়ে দেখায়। পর্যটকদের জন্য মানসম্মত খাবার নেই। থাকার ব্যবস্থাও নাজুক।

সিটি করপোরেশন থেকে একটু বাইরে গেলে সেখানেও ভালো কিছু নেই। বরিশাল-পাটুয়াখালী মহাসড়ক যেটিকে বলা হচ্ছে, সেটি আসলে একদম তৃণমূল পর্যায়ে কোনো আঞ্চলিক সড়কের মতোই। পাশাপাশি দুটো বাস অতিক্রম করতে গেলে যেন রাস্তার বাইরে ছিটকে পড়লো! ওই সড়কের দুই পাশে থাকা বাড়িঘরগুলো সন্ধ্যা নামলেই ডুবে যায় নিকষ কালো আঁধারের রাজ্যে। কোনো ঘরে কুপি, তো কোনটায় হারিকেন। এই হলো বরিশাল।

বরিশাল সিটি করপোরেশনের সড়কবাতির অধিকাংশই জ্বলে না

আধুনিকায়ন এবং উন্নয়নের বিষয় চিন্তা করলে বরিশাল অনেকখানিই পিছিয়ে। এই শহরের চেহারা দেখলে যে কেউই বলবেন বহু বছরের পুরোনো জীর্ণতা তাদের কটেনি। জীর্ণশীর্ণ রাস্তাঘাট, অবকাঠামো, দালান-ঘর; সবমিলিয়ে সেকেলে পরিবেশ।

২ নভেম্বর বরিশালে আমার প্রথম ভ্রমণ। তাই ভেতরের উত্তেজনাটাও ছিলো বাইরে থেকে বোঝার মতো। ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে সকালেও মনের ভেতরে যতটা কৌতুহল, নতুন শহর আর শহরের সৌন্দর্য্য দেখার ব্যাকুলতা ছিলো, বরিশালে পা রাখতেই তা মিইয়ে গেলো। গ্রীণ লাইন ওয়াটার ওয়েজ যখন মেঘনা নদী থেকে ডানে বাঁক কেটে ঢুকে পড়ে কীর্তনখোলা নদীর মোহনায়, তখনও মনে দোল খায় অন্যরকম অনুভূতি।

প্রশস্তের দিক থেকে খুব বেশি বড় নয় কীর্তনখোলা। সে কারণে কাছ থেকে নদীপারের খণ্ড খণ্ড জীবনযাপনও দেখা হয়ে যায়। দেখা হয় হাতের কাছে নদী পেলেই কী করে ইটভাটা নামে নদীর কোলে একেকটি 'হেমলক' তৈরি করা যায়! এতে যে নদীগুলো প্রাণ হারায়, তা হয়তো বাণিজ্যিক চোখে ধরা দেয় না। তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে পর্যটকের সুন্দর ইতিবাচক দৃষ্টিতে।

পরিবেশের অসৌন্দর্য্যতার নিচে নদীনালা-খালবিলের প্রাকৃতিক সুন্দর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না। বরিশালের আশেপাশে অসংখ্য নদীনালা। কীর্তনখোলায় প্রবেশের আগে মেঘনা সামান্য একটু পরেই মিলেছে বঙ্গোপসাগরে। সাগর আর নদীর সম্মিলনস্থলের খুবই নিকটের শহর বলে নদীনালা আর খালবিল বেশি থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে দূষণই হয়ে উঠবে এখানকার স্বাভাবিক ঘটনা!

এই তো গেলো নদী আর পানিপথের কাহনি। সড়কপথ কিংবা জনপথের কী খবর? না, সেখানেও সুসংবাদ নেই।

রুপাতলী এলাকার একজন ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞাসা করলাম- এই শহরে কিংবা এই অঞ্চলে রাজনীতিক নেই? শহরের উন্নয়ন হয় না কেন?

তাঁর তাৎক্ষণিক উত্তর- হিরন দাদা নেই, উন্নয়নও নেই।

হিরন মানে শওকত হোসেন হিরন। ছিলেন বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র। আওয়ামী লীগ-দলীয় এই মেয়র ২০১৪ সালের ৯ এপ্রিলে মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি নগর এবং নগরবাসীর উন্নয়নে কী অবদান রেখেছেন, তার সাক্ষি হয়তো বরিশালবাসী। তবে তাঁর মৃত্যুর ঠিক আড়াই বছর পরের এই বরিশালকে সিটি করপোরেশন মানা যায় না। যেসব যোগ্যতার ভিত্তিতে একটি শহরকে সিটি কর্পোরেশন হিসেবে গণ্য করা হবে, তার কোনটিই এখানে আছে বলে মানতে পারছি না।

একসময় বরিশালকে বলা হতো দেশের অন্যতম সুন্দর শহর। ১৮৭৬ সালে বরিশাল পৌরসভা হিসেবে যাত্রা শুরু করে। ১০৯ বছর পরে এটি প্রথম শ্রেণির পৌরসভার মর্যাদা পায়। ২০০২ সালে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বরিশাল সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠা হয়। যুগের কিংবা শতাব্দীর বদলে যাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বরিশাল পৌরসভা ঠিকই সিটি করপোরেশনে রূপ নিয়েছে। কিন্তু সে অনুযায়ী সুবিধাটুকু বেড়েছে? একটা সময় নাম ছিলো চন্দ্রদ্বীপ। নাম বদলে গেলেও বরিশাল আজো যেন সেই দ্বীপের ঘেরাটোপেই বন্দি। যেই দ্বীপের ছবি আসল বাংলাদেশের চেয়ে অনেকখানিই কুৎসিত!

ভোটের আগে প্রতিশ্রুতি এবং ঘাট পেরোলেই ভুলে যাওয়ার রেওয়াজ থেকে বোধহয় আমরা কিছুটা হলেও সরতে পেরেছি। কিন্তু এই নগরীর ছবি দেখে মনে হচ্ছে, এখানকার রাজনীতিকেরা ভোটের আগে প্রতিশ্রুতিও দেন না। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা সরকারের আমলে এমন বরিশাল একেবারেই বেমানান। স্বপ্নের আধুনিকতার ডিজিটাল বাংলাদেশ পূর্ণতা পাবে কী করে, যদি রাজধানীর বাইরে অবহেলায় পড়ে থাকে এমন অনেকগুলো বরিশাল?