তরুণদের গড়া ‘মহানুভবতার দেয়াল’

জয়নাল আবেদীন
Published : 25 Jan 2019, 11:43 AM
Updated : 25 Jan 2019, 11:43 AM

যশোরের মণিরামপুর উপজেলার রাজগঞ্জের ঝাঁপা গ্রামে নয় কিলোমিটার দীর্ঘ একটি বাওড় আছে। প্রায় আধা কিলোমিটার চওড়া এই বাওড়ের দুই পাশে নয়টি গ্রাম। হাসপাতালে যাওয়া, বাজার করা, স্কুলে আসা-যাওয়া থেকে দৈনন্দিন জীবনের অনেক কাজেই এসব গ্রামের মানুষদের বাওড়ের এপাশ-ওপাশ হতে হয় নিয়মিত। কিন্তু একমাত্র মাধ্যম হলো নৌকা।

একবার নৌকা পেতে দেরি হওয়ায় বাওড় পাড়ে অপেক্ষমান এক মুমূর্ষ রোগীর মৃত্যু হয়। ২০১৪ সালে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিতে যাওয়া একদল শিক্ষার্থী বহনকারী নৌকাডুবির মতো ভয়ংকর ঘটনাও আছে। এসব কারণে নয় গ্রামের মানুষের কপালে দেখা দেয় দুশ্চিন্তার ভাঁজ। অনেক দেন-দরবারের পরেও একটি সেতু বা ব্রিজ নির্মাণের সরকারি ব্যবস্থা হয় না। তাহলে উপায় কী? সারাজীবন মানুষ শুধু ভুগতে থাকবে?

কিছু একটা  করার নেশায় জোট বাঁধতে শুরু করলো এলাকার তরুণ যুবকেরা। তাদের সঙ্গে জ্যেষ্ঠদের ছায়াও থাকলো। তারপর ৫৬ তরুণ-যুবকের সমন্বয়ে গঠিত হলো 'ঝাঁপা গ্রাম উন্নয়ন ফাউন্ডেশন'; যার প্রধান উদ্দেশ্যই হলো বাওড় পারাপারে নিরাপদ ব্যবস্থা। কিন্তু কী হবে সেটি? সেতু, ব্রিজ, না কি অন্যকিছু? সবাই মিলে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট হারে ফি জমা দেওয়া শুরু করলেন। একদম নিঃস্বার্থ দান যাকে বলে। কেউ কেউ নির্ধারিত পরিমাণের চাইতে বেশিই দেন।

একদিন বাওড়ের ধারে বসে গল্প করছিলেন ওই ফাউন্ডেশনের পাঁচ-সাতজন সদস্য। হঠাৎ তারা খেয়াল করলেন, পানির ওপর ছয়টি প্লাস্টিকের ড্রাম দিয়ে লোহার এঙ্গেলের ওপর দুটি শ্যালো মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলনের কাজ করছেন কয়েকজন।

সংগঠনের সদস্য আসাদুজ্জামান ভাবলেন, পানির ওপর ড্রাম যদি শ্যালো মেশিনের ভার নিতে পারে তবে মানুষের ভার কেন নয়? শুরু হলো আলোচনা। গ্রামবাসীদের নিয়ে বৈঠক। এরপর পরীক্ষামূলক ২০টি ড্রামে লোহার এঙ্গেল বসিয়ে জনা পঞ্চাশেক মানুষ দাঁড়িয়ে গেলেন। পরীক্ষা সফল। এরপর শুরু স্বপ্নের কাজ।

জোগাড় হলো ৮০০ প্লাস্টিকের ড্রাম, প্রয়োজনীয় লোহার এঙ্গেল এবং শিট। নির্মাণ হয়ে গেলো এক হাজার ফুট দীর্ঘ এবং ৮ ফুট চওড়া ভাসমান সেতু। লাল নীল রঙের দৃষ্টিনন্দন সেতুর ওপর দিয়ে চলতে শুরু করে নয় গ্রামের মানুষ। রিক্সা-ভ্যান চলে, মোটরসাইকেল চলে। মানুষের মনে বয়ে যায় আনন্দের বান। দূর থেকে লোকজন ছুটে আসে অদম্যদের অসামান্য কাজটি সচক্ষে দেখতে। মণিরামপুর ছাড়িয়ে সারা দেশে তারুণ্যের ইতিবাচক ভাবনা আর বাস্তবায়নের দৃষ্টান্ত হয়ে গেলো ভাসমান সেতুটি।

আগামীর সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্নসারথী মণিরামপুরের এই অদম্য তরুণেরা। তাদের মতোই ছড়িয়ে ছিটিয়ে সারা বাংলায় আরও অগণিত তরুণ যুবক। দেশের প্রতিটি প্রান্ত আজ সজীব, প্রাণবন্ত। এই অদম্যরা সজাগ আছে বলেই সবকিছু জীবন্ত লাগে।

তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের শতাব্দী এটি। ফলে টেকনাফে যখন রোহিঙ্গাদের কান্নায় মানবহৃদয় কেঁদে ওঠে, কিছুদিন পর আবার তেঁতুলিয়া কিংবা কুড়িগ্রামের বানভাসী মানুষের আর্তনাদে আবেগাপ্লুত হয় মানুষ। ত্রাণ নিয়ে ছুটে বেড়ায় সবাই। সংঘবদ্ধ হয় কিছু করার নেশায়। দেশের এক কোণে হওয়া ভালো কাজটি মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। অনুকরণ হয় অন্য এলাকায়।

অনুকরণের সর্বশেষ এবং বিস্ময়কর নজির হলো 'মহানুভবতার দেয়াল'। এটি এখন ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। বিভিন্ন এলাকায় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো  তৈরি করছে মহানুভবতার দেয়াল বা মানবতার দেয়াল। যেখান থেকে একজনের রেখে যাওয়া জিনিস অন্যজন অনায়াসে নিতে পারছে ব্যবহারের জন্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ধারণাটি।

কিশোরগঞ্জের দক্ষিণ মুকসেদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা তানজীনা নাজনীন মিষ্টির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এই উদ্যোগ। স্কুলের শিক্ষার্থীদের মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে কয়েক মাস আগে তানজীনা নাজনীন তার স্কুলে এটি চালু করেন এবং ফেইসবুকে পোস্ট করেন।

অবশ্য তিনি এই ধারণাটি পেয়েছিলেন মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার আড়পাড়া স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ইয়াসমিন আক্তারের কাছে; যিনি নিজের স্কুলে মানবতার দেয়াল চালু করেন ২০১৪ সালের শেষদিকে। এই দুজন স্কুলশিক্ষিকার ধারণাটিই আজকের বাংলাদেশে মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

কিছুদিন আগে নিজের উপজেলা মিরসরাইয়ের বারইয়ারহাট পৌরসদরে গার্লস স্কুল সড়ক হয়ে যাচ্ছিলাম। সড়কের একপাশে একটি বোর্ড দেখলাম। তাতে লেখা ছিল মানবতার দেয়াল। ঝুলছিলো দুটি পুরোনো জামা। অভিভূত হয়ে গেলাম। বিন্দু পরিবার নামক তরুণদের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগেও 'মানবতার দেয়াল' দেখেছি। ওই দুই স্কুলশিক্ষিকার ধারণাটি যে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, এটিই অন্যতম প্রমাণ।

আমরা যারা তরুণ-যুবক, আমরা সারাক্ষণ একটু বেশি ছটফট করি। এটা কেন হলো, ওটা কেন হলো না? এমন না হয়ে অমন হলে ভালো ছিলো। নানা যুক্তিতর্কে ঠাসা আমাদের আজকের আলোচনা। প্রতিদিনের নানা কুৎসিত চিত্রে বিরক্ত হয়ে আমরা একটি সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি। মনেপ্রাণে সেটিই বাস্তবায়ন করতে চাই। মনে মনে ভাবি,  আমি যদি একবার সুযোগ পেতাম। আমাদের প্রত্যেকের মনে এই যে ভাবনা, এটি কিন্তু ব্যক্তিস্বার্থ নয়, সামগ্রিক দেশ পরিবর্তনেরই অংশ।

এখন সারা দেশে গড়ে উঠেছে অগণিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সামাজিক সচেতনতা তৈরি, অসহায় মানুষের সহায় হওয়া, মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা, নেশামুক্ত সমাজ গঠন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে গলা ছেড়ে স্লোগান দেওয়া, অনিয়মের বিরুদ্ধে হাত উঁচিয়ে প্রতিবাদ জানানোর মতো কত কত ইতিবাচক চিত্র আমরা দেখছি।

এখন দুস্থ মানুষেরা সহায়তা পাচ্ছে। নানারকম চিকিৎসা পাচ্ছে। চক্ষুশিবির হয়, মেডিক্যাল ক্যাম্প হয়। রক্তদান কর্মসূচি হয়। শীতের মৌসুমে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ হয়, সুবিধাবঞ্চিত ও অনগ্রসর শিশুদের রঙ বেরঙের শীতের জামা উপহার দেওয়া হয়।

শিক্ষামূলক কার্যক্রম চলছে, নানারকম বৃত্তি পরীক্ষা হচ্ছে; যেটি কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জ্ঞান বিকাশ ও বৈশ্বিক ধারণায় এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে বড় সহায়ক। উপকূলীয় এলাকায় তালের আঁটি রোপন করা হচ্ছে; পরিবেশের বন্ধুই কেবল নয়, বজ্রাঘাতজনিত মৃত্যু ঠেকাতে যেটি ভীষণ কার্যকর।

সম্ভাবনাময় তরুণ যুবকেরা কাজ করছেন। আশার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তাতে আলোকিত হচ্ছে একেকটি জনপদ। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই কাজগুলির কোনোটিই কোনো ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের জন্যে নয়। একেবারে মনপ্রাণ উজাড় করে স্বেচ্ছাসেবী তরুণ যুবকেরা কাজগুলি করে বেড়াচ্ছেন মানবতার কল্যাণে।