গুজব ছড়াল কারা?

জয়নাল আবেদীন
Published : 10 August 2019, 05:24 AM
Updated : 10 August 2019, 05:24 AM

ভয়ংকর গুজবের ঘটনা ১৭৫০ সালে ফ্রান্সে। দেশটির রাজধানী প্যারিসের রাস্তা থেকে শিশুরা অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিলো। কেউ জানতো না কেন। তাদের মা-বাবারা রাস্তায় দাঙ্গা করতো। এই খারাপ সময়ের মাঝখানে একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে রাজা লুইস কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং তিনি বাচ্চা অপহরণ করতেন যাতে তাদের রক্তে গোসল করতে পারেন (সে সময় শিশুদের রক্তে গোসল করলে কুষ্ঠ রোগ ভালো হয় বলে ধারণা ছিলো)।

তবে গুজবের মধ্যে কিছু সত্যতা ছিলো। কর্তৃপক্ষ শিশুদের নিয়ে যাচ্ছিলো, কিন্তু রাজপ্রাসাদে না। অনাকাঙ্খিতদের রাস্তা থেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য পুলিশদের অর্থ প্রদান করা হয়েছিলো এবং রাস্তায় কোনো শিশু পাওয়া গেলেই তাদের আটক করে নিয়ে যাওয়া হতো। সৌভাগ্যবশত বেশিরভাগই তাদের বাবা-মায়ের সাথে পুনরায় মিলিত হয় এবং রাজার ভয়াবহ স্নান অনুষ্ঠানের গুজবগুলি বিশ্রামে চলে যায়।

প্যারিসের রাজার রক্তস্নানের গুজব বিশ্রামে গেছে সত্যি; ২৭০ বছর পরেও গুজব কিন্তু থেমে নেই। এটি নানা দেশে নানাভাবে আজও টিকে রয়েছে। আমরাও ছোটবেলা থেকে শুনে আসছিলাম যে ব্রিজ কালভার্ট সেতু নির্মাণের সময় মানুষের রক্ত লাগে; বলি দেওয়া হয়। যদিও কখনও কেউ দেখেনি নিজের চোখে কাউকে বলি দেওয়া হলো কি-না।

এত বছর পরে খুব জোরালোভাবে আবারও সেই গুজব। সেটি বাংলাদেশেই। পদ্মাসেতু নির্মাণের জন্য শিশুদের মাথা লাগবে বলে জোরেশোরে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামের মা-বাবারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। বাচ্চাদের স্কুল থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে শুরু করেন। বাচ্চাদের ঘর থেকে বের হতে দেন না। খেলতে যেতে মানা করেন। একরকম ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়ে যায় সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে।

নির্মাণকাজের জন্য মাথা লাগবে— এ ধরনের গুজব এটাই প্রথম না। বরং বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এ ধরনের গুজব যুগে যুগে ছড়িয়েছে। একবার ইন্দোনেশিয়ার কিছু অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লো যে সরকারের বিশাল বিশাল নির্মাণ কাজের জন্য মানুষের মাথা বলি দেওয়া হচ্ছে। স্থানীয়দের মাঝে বিশ্বাস দৃঢ় হয়ে যাচ্ছিলো যে নির্মাণ প্রকল্পগুলো যাতে ভেঙে না পড়ে এ জন্য মানুষের মাথার বলি দেওয়া হতো।

১৯৩৭ সালের ঘটনা এটি। ১৯৭৯ সালে দেশটির বর্নেওতে একই ধরনের গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এবারও গুজবের মূলে মানুষের মাথা। সরকারি এজেন্টরা নতুন ব্রিজের প্রকল্পের জন্য মাথা খুঁজে বেড়াচ্ছে বলেই গুজব ছড়িয়ে যায়। ১৭৮১ সালে দক্ষিণস্থ বর্নেওতে তেলের খনিতে যাতে কোন সমস্যা না হয় তার জন্য সরকারি এজেন্টরা মাথা খুঁজে বেড়াচ্ছে— এ রকম গুজবও ছড়িয়ে পড়েছিলো। এই গুজবগুলো সাধারণ জনগণের মনে এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিলো যে কেউ খুব প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া ঘর থেকে বের হতো না।

১৭৬১ সালে লন্ডনে দুটি ক্ষুদ্র ভূমিকম্পের কয়েকদিন পরে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে বড় একটি ভূমিকম্প হতে যাচ্ছে। এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো যে ভয়ে পালাতে লাগলো শহরবাসী। যাদের শহর ছেড়ে পালানোর গতি ছিলো না, তারা মাঠে ক্যাম্পিং করে থাকতে লাগলো।

সেকাল থেকে একাল— গুজবের ক্ষেত্রে বড় মিল হলো, এটি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং এক পর্যায়ে অনেক সচেতন মানুষও দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন। বিশ্বাস না করে উপায় নেই-পর্যায়ে চলে যেতে হয়। পদ্মাসেতুর জন্য মাথা লাগবে-গুজবের মধ্যেই নেত্রকোণায় আগন্তুকের থলিতে এক শিশুর রক্তাক্ত কাটামাথা মিললো। সারা গ্রাম গরম হয়ে উঠলো। আগন্তুক যুবককে উত্তম-মাধ্যম দিয়ে সেখানেই মেরে ফেলা হলো। কিন্তু থলিতে ভরে শিশুর কাটামাথা বয়ে বেড়ানোর খবর দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ায় ভীতিটা আরও গভীরতর হয়ে ওঠে। মানুষের মধ্যে যেমন আতংক সৃষ্টি হতে থাকে, তেমনই ক্ষোভও বিরাজ করলো।

পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে যে নিজের শিশুসন্তান নিয়ে রাস্তায় বের হতে ভয় পাচ্ছিলাম আমরা। ছেলেধরা সন্দেহে গণধোলাইয়ের মুখে একবার পড়লে সেখান থেকে জীবন নিয়ে ফেরাটা যে বড় কঠিন। রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করাবেন বলে খোঁজখবর নিতে গিয়ে ছেলেধরা সন্দেহে জনতার ধোলাইয়ে এক নারীর মর্মান্তিক মৃত্যুর পরে উদ্ভুত পরিস্থিতি এবং প্রশাসনের জোর তৎপরতায় গুজবের অনেকটাই সমাপ্তি ঘটে। গুজব ছড়িয়ে দেওয়ার দায়ে অনেককে আটকও করে প্রশাসন।

তবে সত্যিকার অর্থে গুজব কারা ছড়ালো, কোন উদ্দেশ্যে ছড়ালো, এ সব আর জানা হলো না। ইস্যুর চক্রে এ বিষয়টি হারিয়েই গেলো। ২৭০ বছর আগের গুজবের সুযোগ কেউ নিতে পেরেছিলো কি-না, সেই খবর অজানা। তবে এই সময়ের গুজবের ফায়দা পুরোটাই লুটেছে চক্র। ছেলেধরা গুজব ছড়িয়ে দিয়ে কিংবা গুজবের সুযোগ লুফে নিয়ে তারা আসলেই বিভিন্ন এলাকা থেকে বাচ্চাদের অপহরণ করেছে। সুযোগ সন্ধানীদের অবস্থা দেখে ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের বিখ্যাত উক্তি 'কড়িতে বাঘের দুধ মেলে' অনুকরণে এটাই বলতে ইচ্ছে করে যে 'গুজবে বাঘের দুধ মেলে'।

গুজবের বাঘের দুধ মেলার মতোই খুব ভয়ংকরভাবে ফায়দা লুটতে চেয়েছিলেন চুয়াডাঙ্গার এক মাদ্রাসা শিক্ষক। তারই প্রতিষ্ঠানের এক ছাত্রকে দীর্ঘদিন ধরে পাশবিক নির্যাতন করে আসছিলেন তিনি। ওই ছাত্র জনসম্মুখে ঘটনা বলে দেওয়ার হুমকি দিলে খুন পেয়ে বসে শিক্ষকের মাথায়। খুন করে বেঁচে যাওয়ার প্লটও তো রেডি। শ্বাসরোধ করে ছাত্রকে খুন করে ফেললেন। পদ্মাসেতুর কাজে ওই ছাত্রের মাথা চলে গেছে— এমন ভয়ংকর গুজব জায়েজ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ওই ছাত্রের মাথাটা বিচ্ছিন্ন করে পাশের ডোবায় ফেলে দেন, শরীরটা লুকিয়ে রাখেন নিকটস্থ আমবাগানে। সত্যি যে কখনো পাথরচাপা থাকে না। এই কঠিন নির্মম সত্যিটাও উন্মোচিত হয়। শিক্ষক পুলিশের হাতে ধরা পড়ে।

এ তো গেলো মফস্বলের এক সুযোগ-সন্ধানী মাদ্রাসাশিক্ষকের কাণ্ড। শহরে যখন ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব, নাগরিকেরা নাকাল, মৃত্যুর মিছিল বেড়ে চলেছে, সেই কঠিন সময়েই গুজবের সদ্ব্যবহার করতে চাইলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন। ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে 'ছেলেধরার মতো গুজব' বলে নিজের দায় ঢেকে দিতে চাইলেন। দায়টা ঢাকলো কই? অবস্থা এখন এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছালো যে, ১৩ দিনের মাথায় মেয়র খোকন মন্তব্য করতে বাধ্য হলেন যে ডেঙ্গু পরিস্থিতি অত্যন্ত সংকটাপন্ন।

১৭৫০ সালে ফেসবুক ছিলো না।  টুইটার  কিংবা ইনস্টাগ্রাম, ভাইভার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো ছিল না। সামাজিক যোগাযোগের এসব মাধ্যম তো শুক্কুরে শুক্করে আটদিনও হয়নি। তখন তো জনে জনে মুঠোফোনও ছিলো না। তথ্যপ্রযুক্তির চরম উৎকর্র্ষের এই যুগে এসে একটি গুজবের সৃষ্টি হওয়া মানে রকেটগতিতে সেটি বিশ্বব্যাপী আছড়ে পড়া। উৎপত্তিস্থল থেকে কয়েক হাজার মাইল ছড়িয়ে যেতে কয়েক সেকেন্ডই যথেষ্ঠ। এ জন্যে এই সময়ের গুজব ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে। সুযোগ সন্ধানী চক্র চূড়ান্ত রূপে ফায়দা লুটতে পারে। মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। হচ্ছেও।

সুতরাং গুজবের বিরুদ্ধে সতর্ক হওয়া জরুরি। যে সময়ে আমাদের প্রতিভাবান প্রতিশ্রুতিশীল তরুণেরা নানারকম উদ্ভাবনে মত্ত, মঙ্গলের সন্ধানে ছুটছে মানুষ, চাঁদে আবাসস্থলের চিন্তা চলছে; তেমন একটি উন্নত-অত্যাধুনিক সময়ে নির্মাণাধীন সেতুতে মাথা বলি দেওয়ার মতো উদ্ভট কথাবার্তা বিশ্বাস করার আগে নিজের বিবেকের সামনে একবার দাঁড়ান।