ডেডরোড থেকে.. (১)

জয়ন্তসাহা
Published : 4 Feb 2015, 04:08 PM
Updated : 4 Feb 2015, 04:08 PM

এখন আর শহিদ মিনারে আড্ডা দিতে পারি না। অ্যাসাইনমেন্ট বা ক্লাস শেষে ভুলেও পথ মাড়াই না ওপথে। ও পথে যেতেই কি না ঢামেক আর তার বার্ন ইউনিট! এ পথে এখন রোজ গাড়ি ভর্তি করে পোড়া মানুষ আসছে। মানুষগুলোর হাড়-মাংস পুড়ে কী উৎকট, বিশ্রী গন্ধ! তার সঙ্গে নানারকম উদ্ভট ওষুধে মৌ মৌ করছে ঢামেকের বাতাস। দম বন্ধ হয়ে আসে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয় খুব।
পোড়া মানুষ দেখতে দেখতে চোখ পোড়ায়। খুব আঁতকে উঠি, এ দলে হয়তো একদিন আমার নামটিও লেখা হবে। প্রফেসর সামন্ত তার সাঙ্গাপাঙ্গদের নিয়ে নানারকম ওষুধে ওষুধে আমার পোড়া ক্ষতগুলো সারিয়ে তুলতে প্রাণান্তকর প্রয়াস করবেন। হয়তো পেরে উঠবেন.. কিংবা না….তারপর .. আমার মা.. বাবা.. ভাই.. বোন.. বন্ধুর কান্না…. তারপর পোড়া লাশটাকে আবারো পোড়াতে সোজা পোস্তগলা।
আমরা একই গল্প লিখতে, বলতে বড় ক্লান্ত। এভাবে কাহাতক? কতদিন আর মুখ বুজে সহ্য করে যাবো?
প্রতিদিন ঘর থেকে বের হতে গেলেই মা বলছে, "সাবধানে যাস। খুব দূরে কোথাও যাবি না। কাছে গেলে হেটে যাবি। বাসে উঠবি না। যদি বাসে আগুন দেয়.."
মা জানে, আমাকে বাসে উঠতেই হবে। অফিসে আসতে, অ্যাসাইনমেন্টে যেতে বাসে আমাকে চড়তেই হবে। মা খুব ভয়ে থাকে। ভয় থেকে একধরণের ট্রমাই হয়ে গেছে তার। আমি কিংবা ভাই, বাবা… মামা.. কাকারা যখন বাসে চড়ছেন, মা চিৎকার করছেন.."বাসে উঠার কি দরকার?বাস থেকে নাম।… বাসে চড়বা না। বাসে চড়ে পুড়ে মরবা নাকি? সংসার নাই? ছেলেপুলে নাই?"
এই ট্রমা শুধু আমার মায়ের না, আমার মতো আর হাজারো মায়েরও। কিন্তু মাকে এমন ভয়ে রেখেই বাসে চলতে হয়। নিজের জন্য মোটরবাইক কিংবা প্রাইভেটকার কেনার মতো সামর্থ্য নেই আমাদের। আমার মতো হাজারো মানুষ প্রতিদিন মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে ঝুলছে বাসে, লেগুনাতে কিংবা অন্য কোনো যানে।
উৎ পেতে থাকা মৃত্যু যেকোনো সময় এসে ছোবল মারতে পারে আমাদের। আমরা কেউ জানি না। প্রাণভয়ে তো আর ঘরে বসে থাকা যাবে না।
আমি রাজনীতি বুঝি কম। আর দশটা সাধারণ মানুষের মতোই ভোট দিই, যেকোনো একটা রাজনৈতিক দলকে আমিও পছন্দ করি। আমি নিরপেক্ষ নই। এটাই কি অপরাধ? এ দেশে ভোট দেওয়াটা শুধু অপরাধ নয়, বড় রকমের পাপকাজও।
আমরা ভোট দিচ্ছি কাদের? রাজনীতিবিদদের তো? সেই রাজনীতিবিদরা তো প্রতিদিন আমাদের জীবন নিয়ে খেলছেন। পেট্রোল বোমার কারিগরদের দুধ-কলায় পুষছেন। তাদের গাঁটের টাকা যাচ্ছে আমাদের পকেট ফুটো করে। প্রতিদিন ট্যাক্স, ভ্যাটের নাম করে আমাদের টাকা চলে যাচ্ছে সেই বোমাবাজদের পকেটে।
কী একটা চক্র-ফক্রের কথা শোনা যায়। বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন আর কি! কত উপায়ে, কত হাত ঘুরে আমাদের টাকা বোমাবাজরা পেয়ে থাকেন. .সে কথা আমরা এখন জেনে গেছি। কিন্তু আমরা সব বোমার ভয়ে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছি। আর এ সুযোগেই বোমাবাজরা আরও বেশি সাহস পাচ্ছে।
পুরো দেশ এখন স্থবির হয়ে গেছে। রাজধানী ঢাকার চালচ্চিত্রের সঙ্গে পুরো দেশের চালচ্চিত্র মেলাতে কষ্ট লাগে। মফস্বলে বাড়ি বলে জানি কিছুটা। গাড়ি চলছে না, নৌকা চলছে না।
আমাদের ক্ষেতের সরিষা বিক্রি করবো… সেই সরিষা বিক্রির টাকা পেলে আমাদের সংসার চলবে। পাশের বাড়ি জীবন কাকার হলুদ, মরিচ সব গুদামে পড়ে আছে। শহরে আসতে পারছে না। কিন্তু কিভাবে? গাড়ি ছাড়লেই বোমার ভয়। যদি পুড়ে যায়? তার চেয়ে গ্রামের বাজারে কম টাকায় বিক্রি করছি।..

গ্রামের এমন হাজারো সংসার চলছে কি করে.. তা আমাদের রাজনীতিবিদরা জানেন না… জানতে চান না। তাদের ঘরে রোজ আনাচ আসছে। তরতাজা সবজি আছে। দেশী মুরগি আসছে। তারা এসব ভেবে কি করবেন?

আমাদের বেশকজন আত্মীয়ের ছেলেপুলে এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবার কথা। কিন্তু দেবে কি? ওরা তো ঘর থেকেই বের হয়ে ভয় পায়। পোড়া মানুষের বৃত্তান্ত শুনে এক কাজিন আমার ভীষণ ভয় পেতে পেতে এখন ঘরকুনো। সে বলেছে, সে পড়াশোনা করবে না, স্কুলে যাবে না। যদি তার স্কুলভ্যানেও পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে মারে?

তার মতোই অনেক শিশু এখন স্কুলে যেতে ভয় পায়। স্কুলভ্যানে উঠলেই বাচ্চারা কান্না শুরু করে। খিলগাঁও.. মুগদা এলাকাতে সহকর্মীদের শিশুদের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা শুনতে পেলাম।

আমাদের দেশ সবুজের দেশ, পাখির দেশ.. নদীর দেশ। সেই সঙ্গে আমাদের দেশটা অনেক বিশেষজ্ঞের দেশও বটে। টিভিচ্যানেল খুললে বিজ্ঞাপন নয়, এখন আপনি বিরক্ত হবেন এসব বিশেষজ্ঞের বয়ানে। বিশেষজ্ঞরা নানারকম থিওরি দিচ্ছেন। কেউ বলছেন দ্বিপাক্ষিক সংলাপের কথা, কেউ বলছেন সংলাপের কপালে লাত্থি মারি। কেউ বলছেন সরকারি দল অ্যাকশনে যাও এবার, কেউ বলছেন হার্ডলাইনে গেলে মানবতা লঙ্ঘিত হবে। … কেউ আবার ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে পথে নেমে প্রতিবাদও জানাচ্ছেন..।
কিন্তু বন্ধ হচ্ছে বোমা মারা? বন্ধ হচ্ছে না। বন্ধ হবেও না।

টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া… তামাবিল থেকে বেনাপোল… বাংলাবান্ধা থেকে আখাউড়া… গাড়িতে বোমা পড়বেই। একের পর এক লাশের গন্ধে মৌ মৌ করবে ঢাকার বাতাস। ঢামেকের সামনের সড়কটি ভরে উঠবে শিশু থেকে বৃদ্ধের লাশে। সরকার বলবে 'এটা সাবেক বিরোধী দলের কাজ', আর সাবেক বিরোধী দল বলবে.'গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে দু–চারটা লাশ পড়তেই পারে.' নইলে বলবে. 'সরকারি দল বোমা মেরে আমাদের নামে মামলা দিচ্ছে।"

ঢাকা মেডিকেলের সামনের সড়কটির নাম হয়ত একদিন বদলে যাবে। বদলে গিয়ে রাখা হবে 'ডেড রোড' কিংবা পোড়া মানুষদের নিয়ে কোনো একটা নামে।

লাশের গন্ধ রাজনীতিবিদদের নাকে এসে পৌঁছায় না। যদিও পৌঁছায় ওরা ভেবেই নেয়, কোনো এক ডাস্টবিন থেকে বুঝি আসছে গন্ধ। সিটি কর্পোরেশনের গাড়ি এসে ময়লাগুলো ফেলে আসবে দূরে কোথাও!

তারপর আগুনে পোড়া চাকরীজীবি.. ছাত্রছাত্রী কিংবা গৃহিণীদের ঠাঁই হবে কোনো ভাগারে… এত কবর খোঁড়ার জায়গা কই?. শ্মশান ভরে উঠবে নানাবয়সী লাশের মিছিলে।

… স্বাভাবিক দিনযাপনের পালা বুঝি শেষ। সমাধানের আশা করা আর অরণ্যে রোদন করা একই কথা !