বাংলাদেশে ক্যান্সার সোসাইটিঃ ব্যাবস্থাপনা ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা

জুলভার্ন
Published : 8 Feb 2015, 03:44 PM
Updated : 17 Feb 2011, 02:45 PM

গত তিন তারিখ পালিত হলো বিশ্ব ক্যান্সার দিবস। এই উপলক্ষে বাংলাদেশ ঙ্ক্যান্সার সোসাইটি আয়োজন করে ক্যান্সার সংক্রান্ত একটি সেমিনার। ঐ সেমিনারে দেশের বিশিস্ট ক্যান্সার চিকিতসকগন, ক্যান্সার সার্ভাইভাল ফাউন্ডেশনের সাথে যুক্ত অনেকেই অংশ নেন এবং ক্যান্সার বিষয়ে বিভিন্ন মতামত তুলে ধরেন।সোসাইটির সদস্য হিসেবে ঐ সেমিনারে আমিও উপস্থিত ছিলাম। উক্ত সেমিনারে বিশিস্ট জনদের বক্তব্যের উপর ভিত্তিকরে আমি এই নিবন্ধটি পাঠকদের সাথে শেয়ার করতে চাই। যা পড়ে আমরা কিছুটা হলেও সচেতন হতে পারি।

বাংলাদেশে এমন কোন গ্রাম নেই যে গ্রামে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী নেই। বাংলাদেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। এ দেশের সিংহভাগ মানুষ আজো রোগ, মহামারী, অপুষ্টি, পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। এ দেশের মানুষ ও জীবজন্তুকে প্রতিনিয়ত পরিবেশ ও প্রতিবেশের প্রচন্ড চাপ বহন করতে হচ্ছে। ক্যান্সারসহ বহু দুরারোগ্য ব্যাধির শিকার হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশস্থ্য প্রধান সমন্বয়ক তাঁর নিবন্ধে জানান-২০০৫ সালে সমগ্র বিশ্বে ৭.৬ মিলিয়ন লোক ক্যান্সারে মারা গেছে এবং আগামী ১০ বৎসরে অর্থাৎ ২০১৫ সাল নাগাদ বিশ্বে শুধু ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করবে ৮৪ মিলিয়ন লোক, যদি দেশে দেশে জাতীয় ক্যান্সার ম্যানেজমেন্ট পদ্ধতি জোরদার করা না হয়। পৃথিবীর দক্ষিণ এশিয়ার নিম্ন আয়ের ১৬টি দেশে প্রায় শতকরা ৬০ ভাগ লোক বাস করে। এশিয়ার এই ১৬টি দেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ।
দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিবছর নতুন করে ৬ মিলিয়ন লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ১০ বৎসর পূর্বে এ এলাকার মানুষের গড় আয়ুষ্কাল মাথাপিছু গড় জি.এন.পি চিকিৎসা সুবিধা যা ছিল বর্তমানে তার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। হংকং, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এক্ষেত্রে অনেক উপরে। এ অঞ্চলের মানুষের কাছে শতায়ু আয়ুষ্কাল স্বাভাবিক বলে মনে হয়। আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর পূর্বে পাকভারত উপমহাদেশে মানুষের গড় আয়ুষ্কাল ছিল ২৭ বছর, যা এখন বেড়ে গড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০-৭০ বছর। একটি দেশের মানুষের জীবন যাত্রার মান সে দেশের অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল। আর অর্থনীতি মানুষের স্বাস্থ্যের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সুস্থ মন ও শরীরের মানুষ অধিক জ্ঞানী, পরিশ্রমী এবং অধিক আয় করতে পারে। অধিক আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত ও সুন্দর হয়। উল্লেখিত দেশসমূহের অধিকাংশ মানুষের ভাগ্যে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সুযোগ গ্রহণ এখনও সম্ভবপর হয়ে উঠেনি প্রধানত অর্থনৈতিক কারণে।
এটা স্পষ্ট যে, ক্যান্সার ম্যানেজমেন্ট পদ্ধতি জোরদার করা হলে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার এ ১৬টি দেশের মানুষকে মরণব্যাধি ক্যান্সার হতে অনেকাংশে রক্ষা করা সম্ভব হবে। এ অঞ্চলের দেশগুলোর ক্যান্সার রোগের প্রধান কারণগুলো প্রায় একই। তাই এ ম্যানেজমেন্ট পদ্ধতিও একইরকম হবে। সচেতনতা সৃষ্টি করে ক্যান্সার প্রতিরোধ কার্যক্রমকে জোরদার করা যায়। প্রতিটি দেশে ক্যান্সার রোগের কারণ, ধরন, প্রকৃতি প্রাথমিক অবস্থায় নির্ণয় ও নিরূপণ সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করানো প্রধান কাজ। চিকিৎসা সম্পর্কে দেশের জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে। জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও ক্ষমতাসীন দলকে এগিয়ে আসতে হবে। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে ক্যান্সার ম্যানেজমেন্ট কার্যক্রম সফল করে তোলা সম্ভব।

যুক্তরাজ্যে ১৯৯৮ সালে ক্যান্সার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম জোরদার করার জন্য সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়েছিল। গত ৮ বছরে যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিকভাবে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করার ফলে ক্যান্সার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ফলপ্রসূ হয়েছে। একটি নতুন ভিশনকে সামনে রেখে যুক্তরাজ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টি, সামাজিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যকর্মী ও জনগণকে প্রশিক্ষণ প্রদান, প্রতিরোধ ব্যবস্থার উন্নয়ন, রোগ নির্ণয় পদ্ধতি ও চিকিৎসার উন্নয়ন করে একটি জাতীয় স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার এ ১৬টি দেশের সরকারকে ক্যান্সার ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থা রাজনৈতিক লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহে ক্যান্সার অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। উন্নত দেশসমূহে ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে, অপরদিকে উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রদান ও ব্যথা উপশমকরণের মাধ্যমে ক্যান্সার ম্যানেজমেন্ট পদ্ধতি এগিয়ে চলছে। বাংলাদেশের ক্যান্সার ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থা জোরদার করার লক্ষ্যে সুস্পষ্ট এবং বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ অপরিহার্য। ক্যান্সার রোগের কারণ সম্পর্কে দেশের জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে ক্যান্সার রোগের ধরন সিস্টেম সম্পর্কে জনগণকে সতর্ক করে তোলা। বিলম্বে নির্ণিত ক্যান্সার রোগের চিকিৎসার জন্য আধুনিক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ব্যথা উপশমকরণ পদ্ধতি স্থায়ীকরণের মাধ্যমে রোগীকে আরামে বেঁচে থাকার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে।

আলোচকদের মতে-বাংলাদেশসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে ক্যান্সার ম্যানেজমেন্ট পদ্ধতি জোরদার করার জন্য নিম্নোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ অতীব জরুরিঃ-

(১) জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করে ধূমপান বন্ধ করা, হেপাটাইটিস ইনজেকশন নেয়া, প্যাপিলোমা ভাইরাস রোধ ইনজেকশন গ্রহণ এবং সর্বোপরি সুস্থ জীবনযাপনের উৎসাহ সৃষ্টি করা।

(২) ক্যান্সার ম্যানেজমেন্টের স্তরসমূহ যথাক্রমে পরিকল্পনা, সতর্কতা অবলম্বন এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার, ক্যান্সার রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা এবং পুনর্বাসন সতর্কতা। পুনর্বাসন সতর্কতা সবচেয়ে দরকারি স্তর।

(৩) শরীরের যে কোন অনিয়মিত সংকেতকে গুরুত্ব দিয়ে যথাশীঘ্র ডাক্তারের শরনাপন্ন হওয়া।

(৪) পুনর্বাসন সতর্কতা সোসাইটি গঠন: সমাজের প্রতিটি স্তরে বিশেষ করে স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, স্কুলের শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, সরকারি কর্মচারি ও সমাজপতিদের সমন্বয়ে সোসাইটি গঠন করে জনগণের মধ্যে সচেতনতা কার্যক্রম ছড়িয়ে দিতে হবে। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে এ কার্যক্রমকে জোরদার করতে হবে।

(৫) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং প্রতিটি দেশের সরকারকে যৌথভাবে কার্যক্রম গ্রহণ করে আন্তরিক সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসলেই ক্যান্সার ম্যানেজমেন্ট এবং ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।

(৬) উন্নয়নশীল ও গরীব দেশসমূহের জনগণের মধ্যে অধিক সচেতনতা সৃষ্টি করাই ক্যান্সার প্রতিরোধে প্রধান ভূমিকা।

(৭) বাংলাদেশে কোয়ালিফাইড মেডিক্যাল ফিজিচিস্ট তৈরি করা প্রয়োজন। এ অঞ্চলে প্রয়োজনীয় সংখ্যক মেডিক্যাল ফিজিচিস্ট নেই। দক্ষ এবং অভিজ্ঞ মেডিক্যাল ফিজিচিস্ট, টেকনিশিয়ান এবং ডাক্তারের সমন্বয়ে গঠিত টিম আধুনিক ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য অপরিহার্য। অপরদিকে জনসংখ্যানুপাতে আধুনিক যন্ত্রপাতি যেমন লিনাক, ডজিমিটার, সিমুলেটর, টিপিএসসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি দেশের বড় বড় শহর এবং জেলা সদরের সরকারি হাসপাতালে ক্রমান্বয়ে বসানোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

(৮) বাংলাদেশের জনগণকে ক্যান্সার রোগের কারণসমূহ যেমন ধূমপান, আর্সেনিক পানি পান, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ ইত্যাদি সম্পর্কে ভালভাবে সচেতন ও সতর্ক করে তুলতে হবে। সরকার এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে অধিক হারে সচেতনতা সৃষ্টি করে তাদের ক্যান্সারমুক্ত রাখা। ক্যান্সার রোগের কারণসমূহ সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে অবহিত করা এবং ক্যান্সার রোগের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে তাদের জ্ঞান দান করা। এ জন্য ব্যাপকভিত্তিক প্রচারাভিযান ও কার্যকরি দায়িত্বশীল পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যাবশ্যক। ক্যান্সার চিকিৎসার চেয়ে ক্যান্সার যাতে না হয় সেদিকে নজর দেয়াই আমাদের মত দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক, মাধ্যমিক স্তর এবং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ক্যান্সার রোগের কারণ, সংকেত, নিরাময় ইত্যাদি সম্পর্কে স্বাস্থ্য ও সমাজপাঠে বাধ্যতামূলকভাবে নতুন অধ্যায় সংযোজন করতে হবে।

(৯)বাংলাদেশে বর্তমানে স্বাস্থ্যসম্মত আর্সেনিকমুক্ত খাবার পানির খুবই অভাব। সারাদেশে কয়েক লক্ষ অগভীর নলকূপ রয়েছে যা হতে আর্সেনিক মিশ্রিত পানি উঠে। এ পানি পান করে অসংখ্য মানুষ বিবিধ ক্যান্সারসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এ দেশের অধিকাংশ জেলার ভূতলের পানিতে আর্সেনিক দেখা দিয়েছে। এ পানি কৃষি উৎপাদনে ব্যবহারের ফলে শাকসবজি ফলাফলদিতে আর্সেনিকের প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে।

(১০) আর্সেনিকমুক্ত খাবার পানি সরবরাহকল্পে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ এবং বাংলাদেশ সরকারকে ব্যাপকভিত্তিক একটি সুদূরপ্রসারী কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।