ধর্ম, নৈতিকতা এবং রাজনীতিতে সুনীতি

তাজা কলম
Published : 24 Oct 2011, 02:59 PM
Updated : 24 Oct 2011, 02:59 PM

মানবজীবনের অনেক নৈতিকতা বোধই ধর্ম থেকে উৎসারিত এবং ধর্মশাস্ত্রে সংজ্ঞায়িত। এই নৈতিকতার মূল লক্ষ্য হলো সমাজজীবনে শৃঙ্খলা আনয়ন। উদাহরণস্বরূপ, ধর্মীয় বিধিনিষেধের কারণে অবাধ যৌন উচ্ছৃঙ্খলা থেকে সমাজজীবনে শৃঙ্খলা আনয়নে পরিবার প্রথার উদ্ভব । বিবাহ-বহির্ভূত যৌনাচার অনৈতিক, এ চেতনার মূল প্রোথিত রয়েছে ধর্মশাস্ত্রে। শুধু যৌনসম্পর্কের ক্ষেত্রেই নয়, বরং সামাজিক জীবনের সর্বজনীন নৈতিকতা, যেমন– মিথ্যা না বলা, চুরি না করা, ঘুষ না খাওয়া, মানুষ হত্যা না করা ইত্যাদি পৃথিবীর তাবত ধর্মগ্রন্থ আত্মস্থ করে পাপ-পুণ্যের আলোতে ধর্মীয় অনুশাসনে রূপান্তরিত করেছে পৃথিবীতে একটি আদর্শ, নৈতিক সমাজ বিনির্মাণের প্রচেষ্টায়।

প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মীয় অনুশাসন মানবমনে নৈতিকতাবোধ উজ্জীবনে কতটুকু সমর্থ? পাশ্চাত্য সমাজে ধর্মীয় অনুশাসন অনেকটাই অনুপস্থিত এবং গড়পরতা ব্যক্তিমানসে ধর্মীয় চেতনাও ম্রিয়মাণ। সেখানকার সমাজজীবন আবর্তিত হচ্ছে ইহজাগতিকতায়, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিকে কেন্দ্র করে। কিন্তু প্রাচ্যে, যেখানে ধর্ম দৃশ্যমানভাবে এখনো সমাজনিয়ন্তা, সেখানে কি মানুষের মাঝে সর্বজনীন নৈতিকতাবোধ অত্যন্ত প্রবল? মুসলমানপ্রধান দেশগুলোতে আলোকপাত করলে এ বিষয়ে আশান্বিত হওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে শুরু করে পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশ পর্যন্ত নৈর্বক্তিক দৃষ্টিতে সমাজ নিরীক্ষণে এসব দেশ যে নৈতিক অবক্ষয়ে ক্যান্সারাগ্রস্ত, তা নিঃসন্দেহে প্রতীয়মান। অথচ এসব দেশে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের কমতি নেই। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত তথা ইসলামনির্দেশিত অবশ্যপালনীয় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যাও বাড়ছে ক্রমাগত।

এই যেমন বাংলাদেশে শুক্রবারে জুম্মার নামাজে মসজিদ উপচে রাস্তায় নামে নামাজিদের ঢল, রমজান মাসে রোজাদারদের উৎসাহ-উদ্দীপনা, তারাবিহ নামাজে অংশগ্রহণের তাগিদ দেখে মনে হতে পারে দেশটি যেন নৈতিকতার ভিতেই প্রতিষ্ঠিত। কারণ নৈতিকতাবিরোধী কার্যক্রম, যেগুলো হাদীস-কোরানে নিষিদ্ধ, তা তো মুসলমানেরা করতে পারে না। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ উল্টো। ঘুষ, দুর্নীতি, মিথ্যাচার, অনাচারে আজ আমাদের সমাজ রন্ধ্রে রন্ধ্রে জর্জরিত। হাতে গোনা দু-চারজন বাদে খোদ রাষ্ট্রযন্ত্রের উপরিভাগের ক্ষমতাসীন এবং প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গ থেকে শুরু করে সমাজের অপরাপর ক্ষমতাবান ব্যক্তিবর্গ নিজ নিজ বৈষয়িক অবস্থা উত্তরণে নৈতিকতাবিরোধী কাজ করছেন অবলীলাক্রমে। মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত পর্যন্ত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনকারীদের সংখ্যা বাড়লেও ধর্ম তার মূল উদ্দেশ্য, মানবমনে নৈতিকতাবোধ স্থাপনে, আজ ব্যর্থ।

ধর্মের এ ব্যর্থতার কার্যকারণ বিশ্লেষণে ফ্রয়েডের অবচেতন মনকে স্মরণ করতে হয়। বর্তমান সময়ে সংখ্যাগুরু মুসলমান সচেতন মনে বিশ্বাসী হলেও এদের অবচেতন মনে ধর্মবিশ্বাস ততটা প্রবল নয়। বিশেষ করে, ধর্মবিশ্বাসের মূল চালিকাশক্তি পরলোকে শাস্তির ভীতি কিংবা পুরস্কারের প্রলোভন মানুষের অবচেতন মনে আগের মত ক্রিয়াশীল নয়। ক্রমবিকাশের ধারাবাহিকতায় মানুষ আগের চেয়ে অনেক যুক্তিবাদী। ধর্ম হচ্ছে পরিপূর্ণ বিশ্বাসে ইশ্বর তথা ঐশীবাণীতে আত্মসমর্পণ, যা বর্তমান যুক্তিনির্ভর মানুষের অবচেতন মন গ্রহণ করতে দ্বিধাগ্রস্ত। তাই সচেতন মনের প্রভাবে মানুষ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে উৎসাহী হলেও ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে মানবমনে নৈতিকতা বোধ জাগ্রত হচ্ছে না। সত্যিকার অর্থেই ধর্ম হয়ে পড়ছে আচারসর্বস্ব–আমাদের দীর্ঘদিনের অভ্যাস কিংবা সংস্কার, অনেকটা আজান পড়লে বাঙালি মুসলমান নারীদের মাথায় ঘোমটা টানার মতোন।

ধর্ম এবং রাজনীতির উদ্দেশ্যের মাঝে সাদৃশ্য রয়েছে। ধর্মের পারলৌকিকতা কিংবা আধ্যাত্মিকতা বাদ দিলে ইহজাগতিক সমাজ নিয়ন্ত্রণ করাই এর মূল উদ্দেশ্য। রাজনীতিরও মূল উদ্দেশ্য সমাজ নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করা। হজরত মুহাম্মদ (সা)-কে শুধু একজন প্রেরিত পুরুষ কিংবা ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক ভাবলে তাঁকে অবমূল্যায়ন করা হবে। ইসলাম প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তিনি মধ্যযুগে মক্কা-কেন্দ্রিক একটি প্রাগ্রসর রাষ্ট্র স্থাপনে কৃতিত্ব রেখেছেন। এ রাষ্ট্র স্থাপনে তাকে প্রয়োগ করতে হয়েছিল রাষ্ট্রনীতি, সমরনীতি এবং কূটনীতির নানা ক্রিয়াকৌশল। তাই বলা চলে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হয়রত মুহাম্মদ (সা) একজন রাজনীতিকও ছিলেন।

ধর্ম মানবমনে নৈতিকতাবোধ জাগ্রত করতে পারলৌকিক জীবনে শাস্তি কিংবা পুরস্কারের কথা বলে থাকে। এছাড়া নৈতিকতাবিরোধী কার্যক্রমে অংশ নিলে ধর্মে রয়েছে ইহলৌকিক শাস্তির বিধান। সম্ভবত ধর্মবেত্তারা সচেতন ছিলেন যে, শুধু পারলৌকিক শাস্তি কিংবা পুরস্কারের কথা বলে সমাজ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে রাজনীতি ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজ নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা চালায়। সুস্থ রাজনীতিতে এই আইনের শাসনের ভিত হচ্ছে সুনীতি, যা সর্বজনীন নৈতিকতাবোধ থেকেই উৎসারিত।

বর্তমান সময়ের রাজনীতি সুনীতিকে অবজ্ঞা করে দুর্নীতিকে আশ্রয় করেছে। শুধু আমাদের দেশে নয়, মাত্রার তারতম্যে উন্নতবিশ্বেও। উন্নতবিশ্বের রাজনীতির নিয়ন্তা এখন বহুজাতিক কোম্পানি, যাদের মূল উদ্দেশ্য সমাজকে ভোগবাদী দর্শনে আপ্লুত করে নীতিহীনভাবে পুঁজির স্ফীতি ঘটানো। বহুজাতিক কোম্পানির প্ররোচনায় উন্নতবিশ্বের রাজনীতি মানবতাবিরোধী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে দ্বিধাবোধ করে না। উদাহরণস্বরূপ ইরাকে সাদ্দামবিরোধী অন্যায্য, অমানবিক যুদ্ধের কথা উল্লেখ করা যায়, যার নেপথ্য নায়ক ছিলো বহুজাতিক কোম্পানিগুলোই। এই যুদ্ধে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সমরাস্ত্র বিক্রি করা ছাড়াও ইরাকের তেলক্ষেত্রগুলো গ্রাস করার সুযোগও পেয়েছে।

তবে উন্নত বিশ্বের রাজনীতি তবুও বহুলাংশে আইনের শাসনে প্রতিষ্ঠিত। অন্তত তাদের নিজস্ব জনগোষ্ঠীর জন্য। কিন্তু বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই আজ আইনের শাসন অনুপস্থিত। রাষ্ট্রযন্ত্রের প্ররোচনায় দ‍ুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট, অর্থনৈতিক বৈষম্য, শোষণ-নির্যাতন যেন আজ আমাদের ভাগ্যলিপি। দুঃখের বিষয় যারা আজ দেশের রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট, ব্যতিক্রমী দু-চারজন বাদে কেউই দেশের এই অধঃপতনের জন্য ভাবিত নয়। বরং এদের বৈষয়িক স্বার্থের কারণেই রাজনীতি আজ রাহুগ্রস্ত। ক্ষমতালোভী, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকেরা সমাজের বিত্তবান লুম্পেন ধনিকগোষ্ঠীর সাথে হাত মিলিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিকে করেছে নৈতিকতাবিহীন, র্দুবৃত্তায়নগ্রস্ত।

রাজনীতিকে দুর্নীতিমুক্ত করে সুনীতির ভিতে দাঁড় করানোর কোনই উপায় নেই? অবশ্যই আছে। এজন্য গণমানুষকে, যাদের নৈতিকতাবোধ প্রবল, তাদের এগিয়ে আসতে হবে। নেতা কিংবা সংগঠনের জন্য অপেক্ষা করলে মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে যাবে। দুর্নীতিবাজ ক্ষমতালোভীদের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে শনির আখড়া কিংবা কানসাটের মতোই গণমানুষকে ফুঁসে উঠতে হবে। ঐক্যবদ্ধ গণজোয়ারেই স্থানীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে রাজনীতিতে সুনীতি এবং জন্ম নেবে গণমানুষের নেতা। এভাবে দেশের বিভিন্ন অংশে স্থানীয় রাজনীতিতে সুনীতি প্রতিষ্ঠিত হলে অনিবার্যভাবে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে সুনীতি প্রতিষ্ঠিত হবে, এ কথা সুনিশ্চিত।