শেখ হাসিনাকেই সামাল দিতে হবে

কবীর চৌধুরী তন্ময়
Published : 17 Sept 2017, 03:24 AM
Updated : 17 Sept 2017, 03:24 AM

.

মানব সভ্যতার স্বর্ণযুগ একবিংশ শতাব্দিতে এসেও বিশ্বের অন্যতম নিপীড়িত-নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর নাম রোহিঙ্গা। আর এই রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমার সরকারের তান্ডব ইতিহাস রচিত। ১৭৮৪ সালে বার্মার তৎকালীন রাজা আরাকান দখলের পর থেকে এ জনগোষ্ঠীর মানুষের উপর যে হত্যা, বিতাড়ণ শুরু হয়েছিল; মানব সভ্যতার এই সময়ে এসে আরও নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ের ২৪ আগস্ট রাখাইন রাজ্যের ২৪টি পুলিশ চেকপোস্টে হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গাদের উপর নতুন করে মিয়ানমান সরকারের জাতিগত যে নিধনযজ্ঞ শুরু হয়েছে তা মানবসভ্যতার এক কলঙ্কিত অধ্যায়। আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির কল্যাণে রোহিঙ্গাদের উপর পরিচালিত অত্যাচার-নির্যাতন, হত্যা-ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও বিতারণ বর্বরতার চিত্র দেখে বিশ্ব বিবেক আজ থমকে দাঁড়িয়েছে। সকল বয়সী মানুষ আজ এই বর্বরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার।

মিয়ানমার সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে দেশটির উগ্রপন্থী বৌদ্ধদের যৌথভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও ধর্ষণ থেকে প্রাণে বাঁচার স্বপ্নে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে অসংখ্য রোহিঙ্গা। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত ৩ লাখ ১৩ হাজার। তবে বিভিন্ন বেসরকারী সংবাদ মাধ্যমের প্রকাশিত সংবাদ বলে- জাতিসংঘের তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি রোহিঙ্গা তাদের সর্বস্ব হারিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। আল জাজিরার তথ্য অনুযায়ী, মিয়ানমার সরকারের জাতিগত নিধনযজ্ঞ শুরু থেকে এই পর্যন্ত প্রবেশকৃত বাংলাদেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা ৭ লাখ ৩১ হাজার।

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ প্রয়াত জিয়াউর রহমানের সময় থেকে। স্বাধীন-সার্বভৌম দেশকে তিনি মিনি পাকিস্তান কিংবা পাকিস্তানের ছায়া রাষ্ট্র বানানোর স্বপ্নে থাকার কারণে তখন এই সমস্যাটিকে প্রশাসনিকভাবে নজর দেননি। অনুরূপ জেনারেল এরশাদের সেনাশাসনের সময়ও ইচ্ছেমতো ঢুকে পড়া রোহিঙ্গারা বাংলাদেশকে তাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করে আসছে।

প্রবেশকৃত রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা একেবারেই তিক্ত। শত-শত বছর ধরে একসাথে বসবাস করা বাংলাদেশি মুসলমান ও বৌদ্ধদের মধ্যে যে সম্প্রীতি অটুট ছিলো তা রামুর সহিংসতায় মধ্য দিয়ে গোটা বিশ্বের কাছে আমাদের বিতর্কিত ও কলঙ্কিত করেছিল এই রোহিঙ্গারা। তারা শুধু রামুর ঘটনার সাথেই সম্পৃক্তই ছিলো না, টেকনাফ থেকে রামু অব্দি বিশাল এলাকা জুড়ে গড়ে ওঠা ক্যাম্প আর শরণার্থী-বসতিগুলোতে গড়ে তুলেছিল মাদক আর অস্ত্রের আখড়া। দেশের অপরাজনীতিবিদদের সহায়তায় পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে বিদেশের মাটিতেও রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের বদনাম করেছে।

গভীর সাগরে আট বাংলাদেশি মাঝি-মাল্লাকে হত্যা করে লুণ্ঠিত ট্রলার নিয়ে নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরার পথে বাংলাদেশ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে এক রোহিঙ্গা ডাকাত। টেকনাফের আতঙ্ক রোহিঙ্গা ডাকাত সর্দার আব্দুল হাকিম প্রকাশ হাকিম ডাকাতের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ৩ হাজার ৯৩৭ পিস ইয়াবা, চাকু ও ৭টি মোবাইল জব্দ এবং আট লাখ টাকা মুক্তিপণের জন্য বেঁধে রাখা যুবক মোহাম্মদ সেলিমকে উদ্ধার করেছে বিজিবি। মিয়ানমারের বিদ্রোহী সংগঠন আল-ইয়াকিন'র স্বঘোষিত নেতা ও রোহিঙ্গা ডাকাত সর্দার- আবদুল হাকিমের দুই সহযোগিকে কক্সবাজার থেকে ১৭টি অস্ত্র ও চারশ ৩৭ রাউন্ড গুলিসহ আটক করেছে র‌্যাব- এই ধরনের অসংখ্যা সংবাদ সৃষ্টি করেছিল এই রোহিঙ্গা।

বাংলাদেশে সন্ত্রাসী, বোমাবাজী কর্মকাণ্ড করে অনায়াসেই চলে যেত মিয়ানমারে। অনুপ্রবেশকারী বা শরণার্থী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বিপুল জনসংখ্যার বাংলাদেশে শুধু বোঝাই নয়, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য রীতিমত হুমকিও বটে।

রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চার দশকের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী অগ্রিম চিন্তা-ভাবনা বা প্রস্তুতি গ্রহণ না করা এটা আমাদের দূরদৃষ্টির অভাব অথবা ব্যর্থতাই বলা চলে। এমনিতেই বাংলাদেশে রটনার সময় গুরুত্ব না দিয়ে ঘটনা ঘটার পর তড়িঘড়ি করে কাজে নামার চেষ্টা করি। তখন অনেক সময় পার হয়ে যায় কিন্তু সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে সঠিক কাজটি আর সঠিকভাবে করা হয়ে ওঠে না। যেমন, মিডিয়া বাংলাভাইদের তথ্য-উপাত্ত দিলে তখন মিডিয়ার সৃষ্টি বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়। ব্লগার-লেখকদের হত্যার হুমকিতে জিডি করতে গেলে রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্তাব্যক্তিদের অবহেলার পরে যখন খুন হয়, তখন নড়েচড়ে বসে। আনসার বাংলা সেভেন, আইএস, জেএমবি বা বোমাবাজদের নিয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আলোচনা-সমালোচনাকে পাশ কাটানোর পর যখন হলি আর্টিজান হামলার ঘটনায় বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বকে উদ্বিগ্ন করে তুলে, তখন রাষ্ট্রযন্ত্র পরিকল্পনা গ্রহণ করে। শুধু রোহিঙ্গাই নয়, অনুরূপ ঘটনা বা অন্য কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য আমাদের অগ্রীম পরিকল্পনা গ্রহণ রাখা উচিত।

আর রোহিঙ্গাদের উপর নতুন করে মিয়ানমার সরকারের জাতিগত যে নিধনযজ্ঞ, এটি এখন আন্তর্জাতিক রাজনীতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের নেতারা স্বাভাবিকভাবেই তাদের নিজেদের সমস্যা ও স্বার্থের বাইরে পা ফেলবেন বলে মনে হয় না। ঘটনার পরপরই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমারে গিয়েছেন। পাশাপাশি বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েছেন। কিন্তু রোহিঙ্গা নির্যাতন-নিপীড়ন, হত্যা-বিতাড়ণ নিয়ে জোড়ালো কোনো ভূমিকা গ্রহণ করেনি। আমেরিকা বরাবর দ্বৈত ভূমিকা পালন করছে। একদিকে বাংলাদেশের প্রশংসা করছে, অন্যদিকে মিয়ানমার সরকারের সাথে অস্ত্র-ব্যবসা আর মদদও দিচ্ছে সমানতালে।

আবার রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠন আরসা অর্গানাইজেশন প্রধান হাফিজের সাথে পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থার একজন অফিসারের এবং ইরাকের একজন আইএস জঙ্গি নেতার ফোনকল রেকর্ড পাওয়া তথ্য অনুযায়ী- একদিকে সাধারণ রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর মিয়ানমার সরকারের আক্রমণ আমন্ত্রণের মূল উদ্দেশ্যে পাকিস্তান এবং আইএস মিলে আরসাকে দিয়ে মিয়ানমার টহল ছাউনিতে আক্রমণ করে মিয়ানমারের ১২ জন পুলিশ এবং সেনা সদস্যকে হত্যা করে! অন্যদিকে রোহিঙ্গা হত্যা বন্ধের ইস্যুতে মিয়ানমার সরকারের সাথে বসার কৌশল নির্ধারণ করে। নিজের বিশাল ব্যবসায়িক স্বার্থের বাইরেও যাওয়ার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না চীনের কাছ থেকে।

এখন রোহিঙ্গা ইস্যুটির স্থায়ী সমাধানের কৌশল আর কর্মপরিকল্পনাটা বাংলাদেশকেই নিতে হবে। আর সেটা শেখ হাসিনাকে সামাল দিতে হবে। ইতোমধ্যেই 'মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর অব্যাহত নির্যাতন-নিপীড়ন বন্ধ, তাদেরকে তাদের বাসভূমি থেকে বিতাড়ণ করে বাংলাদেশে পুশইন করা থেকে বিরত থাকা এবং রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিয়ে নাগরিকত্বের অধিকার দিয়ে নিরাপদে বসবাসের ব্যবস্থা গ্রহণে মিয়ানমার সরকারের ওপর জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের জোরালো কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানানো হোক-এই মর্মে জাতীয় সংসদে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে।

আবার বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আঙ্গুলের ছাপ গণনা বা বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের আওতায় আনার কাজ শুরু করেছে। অন্যদিকে সুশৃঙ্খলভাবে ব্যক্তি ও সংগঠনের ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য কক্সবাজার জেলা প্রশাসন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এবং সোনালী ব্যাংকের হিসাব নম্বরে সাহায্য পাঠানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। এগুলোর পাশাপাশি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্বাস্থ্যসেবা, জন্মনিয়ন্ত্রণ, শ্রম নিয়েও সরকারকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।

রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আমাদের মূল কাজটি হবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নিয়ে স্থায়ী সমাধানের পথে এগিয়ে যাওয়া। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে ইতোমধ্যেই মানবতার দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্ব নেতাদের কাছ থেকে প্রশংসা অর্জন করেছে। সেটাকে কাজে লাগাতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রোহিঙ্গা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ঐসব রাষ্ট্রগুলোকেও একত্রিত করতে হবে। যেমন পাকিস্তান ৩ লাখ ৫০ হাজার, সৌদি আরব ২ লাখ, মালয়েশিয়া ১ লাখ ৫০ হাজার, ভারত ৪০ হাজার, সংযুক্ত আরব আমিরাত ১০ হাজার, থাইল্যান্ড ৫ হাজার, ইন্দোনেশিয়া ১ হাজার।

আঞ্চলিক জোট আসিয়ান ও এশিয়ার অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকট বিষয়ে এক ডিপ্লোম্যাটিক ব্রিফিংয়ে মিয়ানমারের রাখাইনে অবিলম্বে রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। এখানে আমাদের পররাষ্ট্র দপ্তর শুধু আহ্বান, বক্তব্য, বিবৃতি দিয়েই এই সমস্যার সমাধানের পথ বের করতে পারবে বলে মনে হয় না। এখানে তথ্য-উপাত্ত এবং প্রয়োজনে বর্বরতার ঘটনার ভিডিও ও স্থির চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে হবে। আর 'বাঙালি সন্ত্রাসী' বলে মিয়ানমার যে অপপ্রচার চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধেও শক্ত অবস্থান গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নজর দিতে হবে- স্যোশাল মিডিয়াতে বাংলাদেশের কিছু অনলাইন অ্যাক্টিভিষ্ট'র ভাইরাল করা মিথ্যা ও আপত্তিকর পোস্টের উপর। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিয়ে মৌলবাদ ও স্বাধীনতাবিরোধীদের অপরাজনীতি ঠোকানোর যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।

অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নিধন করা হচ্ছে এবং মিয়ানমারের রাখাইনে সামরিক অভিযানের ফলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর যে আহ্বান করেছিল জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রধান জেইদ রা'দ আল হুসেইন, সেটিকে ফোকাসে আনতে হবে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠন ও বিশ্ব নেতাদের কার কী ভূমিকা তা পর্যবেক্ষণ করে সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কাজ করতে হবে।

জাতিসংঘের তথ্যমতে, আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত ও রাষ্ট্রবিহীন জনগোষ্ঠীর নাম রোহিঙ্গা। মিয়ানমারের আরাকান বা রাখাইন রাজ্যে হাজার বছরের পুরনো এই রোহিঙ্গা সম্প্রদায়। ১০৪৪ সালে আরাকান রাজ্য দখলদার কট্টর বৌদ্ধ বর্মী রাজা আনাওহতা মগদের বার্মা থেকে রোহিঙ্গাদের দক্ষিণাঞ্চলে রীতিমত বিতাড়িত করে বৌদ্ধ বসতি স্থাপন করান।

রাখাইন রাজ্যেও ২টি সম্প্রদায় দক্ষিণে মগ আর উত্তরে রোহিঙ্গার বসতি ছিল। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মগদের দস্যুবৃত্তির কারণেই মগেল মুল্লুক কথাটির প্রচলন হয়। আর এই মগদের দৌরাত্ম্য মাঝে মাঝে আমাদের ঢাকা পর্যন্ত পৌছাত। আর তখনকার মোগলরা মগদের তাড়া করে জঙ্গলে ফেরত পাঠাত।

২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের আরাকান স্বাধীন রাজ্য ছিল ১৪৩০ সাল থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত। পরে মিয়ানমারের রাজা বোদাওফায়া এ রাজ্য দখল করায় চরমভাবে বৌদ্ধদের আধিপত্য বিস্তার লাভ করে। ব্রিটিশ শাসিত ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মিয়ানমার স্বাধীনতা অর্জন করে। তখন বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হতে থাকে মিয়ানমার যা তখনকার পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদেরও প্রতিনিধিত্ব ছিল। শুধু তাই নয়, এই সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর বেশ কয়েকজন পদস্থ সরকারি দায়িত্বও পালন করেছে।

কিন্তু তা আর বেশিদিন থাকতে পারেনি। ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার পর মিয়ানমার যাত্রা শুরু হয় একেবারেই উল্টো দিকে। আর তখন রোহিঙ্গাদের উপর নেমে আসে অমানবিক দুর্ভোগ। সামরিক জান্তা তাদের ভিনদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে। রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার ও ভোটাধিকার থেকেও তখন বঞ্চিত করা হয়। ধর্মীয় রীতিনীতি পালনে বাধা প্রদান, শ্রমে বাধ্য করা, লুটপাটসহ খুন-ধর্ষণ তখন নিত্যদিনের খেলনা হয়ে দাঁড়ায়। আবার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যাতে শিক্ষা অর্জন করতে না পারে তার বাধা প্রদান এবং তাদের জনসংখ্যা বাড়াতে না পারে সে জন্য বিয়ে ও সন্তান গ্রহণের মতো বিষয়ের উপরও নানা রকমের বিধিনিষেধ চাপিয়ে দিয়েছিল।

সেই শুরু থেকে মিয়ানমার মূল ভূখণ্ডের বেশিরভাগ মানুষের কাছে রোহিঙ্গারা 'কালা' নামে পরিচিত। তারা বাঙালি ও ভারতীয়দেরও 'কালা' বলেই আখ্যায়িত করত। আর এই 'কালা' পরিচয় বহনকারী জনগোষ্ঠী তখন সীমাহীন অত্যাচার-নির্যাতনের স্বীকার হতো। কারণ 'কালা' শব্দটি ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে মিয়ানমার বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উগ্রপন্থীরা ব্যবহার করত। এই কঠিন বাস্তবতায় উগ্রপন্থী বৌদ্ধদের তান্ডবের সাথে যখন সম্পৃক্ত হয় রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, হত্যা, ধর্ষণ, বিতারণ; তখন একটু প্রাণ বাঁচাবার আশ্রয়ের জন্য দেশান্তরী হচ্ছে এই রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠী। ভাষা, পোশাক, চেহারা ও শারীরিকি গঠনের দিক দিয়ে আমাদের সাথে প্রায় মিল হওয়ায় এবং প্রতিবেশী দেশের সহযোগিতার আশায় পাড়ি জমাচ্ছে বাংলাদেশে। অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের তুলনায় যার সবচেয়ে বৃহৎ ধকলটি যাচ্ছে বাংলাদেশের উপর।

বর্তমান বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নেই। শেখ হাসিনার সরকারের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা আজ বহু দেশের জন্য উদাহরণ এবং অনুকরণীয়। আর এই বদলে যাওয়া বাংলাদেশের চেহারা প্রতিবেশি রাষ্ট্র বা সরকারের কাছে ভালো লাগার কথা নয়। অনেক রাষ্ট্র নায়কের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশ তার নিজেস্ব ভূমিকায় এগিয়ে গেছে। এটিও সুযোগের সৎ ব্যবহার যে তারা করবে না তাও আমাদের ভাবতে হবে। বিশেষ করে, জাত শত্রু পাকিস্তান যেখানে এখনো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশিদের নিয়ে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে, সেখানে আমাদের সুক্ষভাবে হিসেব-নিকেস করে এগুতে হবে। কৌশল আর আমাদের বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্রনায়কদের নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে রোহিঙ্গা ইস্যুটি স্থায়ীভাবে সমাধানের পথ বের করতে হবে।

জাতিসংঘের আসছে সাধারণ অধিবেশনে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানানোর পাশাপাশি এই সঙ্কটের বিষয়টিও তুলে ধরবেন বলে সংসদে জানিয়েছে শেখ হাসিনা। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর তথ্য-উপাত্ত বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরার জন্য এটি আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগও বটে। পাশাপাশি বিভিন্ন রাষ্ট্র নায়কদের কণ্ঠেও যদি রোহিঙ্গা ইস্যুটির স্থায়ী সমাধানের জোরালো অবস্থান সৃষ্টি করতে পারে তাহলে কার্যত মিয়ানমার সরকার বাস্তব পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে। বিশেষ করে যেসব দেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী আছে তাদেরকে সাথে নিয়ে বিশ্ব নেতাদের সামনে আমাদের যৌক্তিক দাবি তুলে ধরতে হবে। আর সেটা বঙ্গবন্ধু'র কন্যা শেখ হাসিনাকেই করতে হবে। অতীতের জাতীয় সংকট তিনি যেভাবে সামাল দিয়েছেন, আমাদের বিশ্বাস রোহিঙ্গা ইস্যুটিও বিশ্ববাসীর কাছে যথাযথভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হবেন।