মিতুর (ছদ্মনাম) সমবয়সী বন্ধুরা খেলছে। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছে। কোলে ফুটফুটে শিশু দেখে জিজ্ঞেস করলাম তোর বোনের নাম কী? মিতু একটু হাসি দিয়ে বলল, 'এটা হামার বোহিন লয়জি কাকু, হামার বেটি' (ও আমার বোন না চাচা, আমার মেয়ে)। শুনে আমি রীতিমত "থ হয়ে গেলাম। মিতুকে জিজ্ঞেক করলাম, তোর বিয়ে হল কখন? দু'বছর, নিচু স্বরে বলল মিতু।
এরপর আমি সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম, এত অল্প বয়সে বিয়ে! কিছুদিন আগেও গ্রামের অনেকেই জানতো না মিতুর বিয়ের খবরটি। কারণ বিয়েটা যে হয়েছে রাতের আঁধারে। আনন্দ অনুষ্ঠান ছাড়াই খুব গোপনে বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। সন্তানসম্ভবা হওয়ার পর সবাই জানতে পেরেছে বিয়ের খবরটি।
"শিশু হয়েছে শিশুর মা" এর চেয়ে ভয়ঙ্কর আর কী হতে পারে? কোন সাংবাদিক যদি মেয়েটাকে সন্তান প্রসবের আগে দেখতো তাহলে নিশ্চিত 'শিশু যখন গর্ভবতী' বা 'শিশুর পেটে শিশু' এমন শিরোনামে সংবাদ ছাপত।
জেনে খুব খারাপ লাগল। যে সময় বিয়ের অর্থই ভালমত বোঝার কথা নয়, অন্যের বিয়েতেই যখন আনন্দ করার কথা সে রকম সময়ে তার বিয়ে হয়েছে। সংসার কি জিনিস তা এখনো তার বোধগম্য নয়, অথচ সে এখন সন্তানের মা!
খুব চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে ছিল মিতু। বিয়ের সময় পড়ত ষষ্ঠ শ্রেনীতে। মুখে সবসময় হাসি লেগেই থাকত তার। খেলাধুলা আর দুষ্টমিতে বেশ পটু। তবে লেখা পড়াতেও ছিল বেশ মনযোগী। এখন সে আর আগের মত নেই। স্বামীর সংসারে পড়ালেখা বন্ধ। তার চঞ্চলতা যেন কেউ জোর করে কেড়ে নিয়েছে।
এবার আসল কথায় আসা যাক, উপরের ঘটনার প্রধান চরিত্র মিতুর বাড়ি দিনাজপুর জেলার বিরল থানায়। ওই এলাকায় রাতের আঁধারের বাল্য বিবাহ এখন মাহামারি রুপ ধারণ করেছে। কেউ যেন প্রশাসনকে জানিয়ে বিয়ে বন্ধ করে দিতে না পারে সে জন্যই এই নয়া কৌশল। বর্তমানে ধুমধাম আয়োজনের মাধ্যমে খুব কমই বিয়ে সম্পন্ন হচ্ছে। বলতে গেলে দরিদ্র পরিবারগুলোর শতকরা ৯৫ ভাগ এই কৌশল অলম্বন করছে।
বিত্তশালীরাও যে করছে না এমটি নয় কিন্তু। তবে মাত্রাটা তুলনামূলক কম। দিনাজপুর জেলার বিরল থানায় সম্প্রতি থানার কয়েকটি ইউনিয়নে সরেজমিনে ঘুরে এমন খবরই জানা গেল। সে এলাকার শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বললে তারও একই কথা শোনাল। রাত ছাড়া যেন বিয়েই হয় না তাদের এলাকায়। আমার মনে হয় শুধু দিনাজপুর নয় বাংলাদেশের অন্যত্রও রাতের আঁধারে সবার অগোচরে বাল্যবিবাহের প্রচলন চলছে।
রাতের আঁধারে বিয়ে কেন?
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে রাতের আঁধারে বাল্য বিবাহের কয়েকটি কারণ জানা গেল। প্রথমত, বাল্য বিয়ে বেআইনি তাই। দ্বিতীয়ত, কোন বিয়েই যৌতুক ছাড়া হয় না। ফলে যৌতুকের বোঝা হালকা করতেই দারিদ্র্য পীড়িত এসব পরিবার অনুষ্ঠান বর্জন করছে। তবে অনেক ধনী পরিবারেও রাতের আঁধারে বিয়ে দেখা গেছে। তৃতীয়ত, মেয়ের নিরাপত্তার (দুষ্ট ছেলে থেকে) কথা ভেবে। চতুর্থত, মেয়ের বয়স বেশি হলে বিয়ের ভালো প্রস্তাব আসে না। আবার বয়স বেশি হলে মেয়েদের নামে নানান কটু কথা বলা হয় চারপাশ থেকে। মূলত এসব কারণেই রাতের আঁধারে বাল্য বিবাহের এরকম আয়োজন।
কাজিদের কৌশল:
বিয়ে পড়ানেরা ক্ষেত্রে পাত্র ও পাত্রীর যাবতীয় তথ্য গোপন খাতায় লিখে রাখেন কাজি। তবে সেটা মূল খাতায় তোলেন না। যখন দম্পত্তির সন্তান হয় তখন কাজি পাত্র-পাত্রীর সঠিক (আইনে বর্নিত বিয়ের বয়স) বয়স দেখিয়ে তা খাতায় রেজিস্ট্রেশন করে নেন।
চাই কার্যকর প্রতিরোধ:
বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে নতুন করে আর কিছু বলার নাই। বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ করতে হলে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নজরদারিতা বাড়াতে হবে। বা্ল্যবিয়ে বন্ধে প্রয়োজনে গোপন সেল গঠন করতে হবে। বাল্যবিয়ের খবর পেলেই এলাকার শিক্ষিত শ্রেনী বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা প্রশাসনকে জানিয়ে দিত। এজন্য গত কয়েক বছর থেকে রাতের আঁধারে বিয়ের এই নতুন রীতি শুরু হয়েছে। তাই বিশেষ করে কাজিদের উপর নজরদারি বাড়াতে হবে। দোষীদের বিরুদ্ধে কঠিন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি আমাদের সামাজিক সচেতনা বাড়াতে হবে।