'এই তোমার বসের খবর কি? ঘুমাচ্ছে?' মিন্টু রোডে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া ও কমিউনিটি শাখায় দেখা হলেই এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতাম। তার দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমাদের চিফ ক্রাইম রিপোর্টার পিনাকি দা'কে নিয়ে এমন প্রশ্ন করতেন তিনি।এর পর স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে কী আছে বলো, জিজ্ঞেস করতেন তিনি। কিছু নাই (মানে আজ কোনো নিউজ নেই) বলতেই পকেটে থাকা নোটবুকটা দেখতে চাইতেন। বয়স এবং পেশায় তিনগুন সিনিয়র মানুষটার মধ্যে এসবের কোন ছাপ ছিল না। চলনে, বলনে একেবারে সোজা। -আমি আমাদের বিভাস দা'র কথা বলছি। দি ইন্ডিপেন্ডেন্টের সিনিয়র রিপোর্টার বিভাস চন্দ্র সাহা। আমরা যারা অনুসন্ধানী আর অপরাধ বিষয়ক রিপোর্টের পেছনে ছুটি-তাদের সবার দাদা। কিন্তু বলতে কষ্ট হচ্ছে- আমাদের দাদা আর নেই। শুক্রবার (১১ মে) বিকেলে ধানমন্ডিতে আমাদের দাদার প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ঘাতক বাস।
পুলিশ এমন কেন?
বিভাস দা'র নিথর দেহ পড়ে আছে ধানমন্ডির ২ নম্বর সড়কে। মাথার হেলমেটটি ঘাতক চাকায় পিষ্ট হয়ে গেছে। সঙ্গে দাদার মাথাটিও। দাদার মাথা থেকে বের হওয়া রক্ত কালো পিচ ঢালাই রাস্তাটিতে গড়িয়ে পড়ছে। এর অদূরেই পুলিশ দাঁড়িয়ে। কেউ উদ্ধার করছে না আমাদের দাদাকে। এমন অবস্থায় দেখে দুই নম্বর সড়কে স্থানীয় লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। বিক্ষোভ করে ঘাতক বাসটি আটক করে আগুন ধরাতে চায় উত্তেজিত যুবকরা। এসময় টনক নড়ে পুলিশের। ওই যুবকদের ওপর চলে পুলিশের লাঠিপেটা। যুবকরা আরও ক্ষিপ্ত হয়। পুলিশ 'গ্যাস ও গুলি ছুড়ে'। প্রাণ ভয়ে পালিয়ে যায় বিক্ষোভকারীরা। আমাদের বিভাস দার লাশটি আরও কিছুণ পড়ে থাকে রাস্তায়। পরে অদূরে পপুলার হাসপাতালে নেওয়া হয় দাদাকে। ততক্ষণে প্রিয় বিভাস দা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন-যেখান থেকে আর কেউ ফেরে না। সহকর্মীর মৃত্যুর খবর পেয়ে ছুটে যাই আমরা। আমাদের সাংবাদিক নেতারা। পুলিশ সাংবাদিকদের সঙ্গেও অসৌজন্যমূলক আচরণ করে। সহকর্মী হারিয়ে ক্ষিপ্ত সাংবাদিকরা রাম্তায় নামতে চাইলে পুলিশ লাঠি পেটা করে। এমন অপকর্মে নেতৃত্ব দেন ধানমন্ডি থানার ওসি মহোদয়! হায়রে পুলিশ!
আমি ব্রেকিং নিউজ করেছিলাম:
কয়েক মাস আগে শান্তিবাগের বাসার নিচ থেকে বিভাস দার মোটর সাইকেলটি চুরি হয়ে গিয়েছিল। আমি মোটর সাইকেল হারানোর নিউজ করেছিলাম। পরের দিন দেখলাম- এই নিউজটা তেমন কোন পত্রিকায় আসেনি। ফোন দিয়ে আমি যখন জানালাম, দাদা আপনার মটর সাইকেল হারানোর নিউজটা আপনার পত্রিকায় তো আসেনি। অন্য কোন পত্রিকায় দেখলাম না। দাদার সেই স্বভাবসুলভ মজার উত্তর- 'অন্য কেউ লেখেনি ভালোই হইছে। তোমারটা ব্রেকিং নিউজ হয়ে গেছে।' দাদা আপনাকে খুব মিস করবো।
আর নিউজ চাইবেন না দাদা:
মাঝেমধ্যেই বিকেলে দাদার ফোন। …নিউজ লাগবে। এখনই মেইল পাঠাও। বলতাম দাদা এখনও লেখা শেষ করিনি। দাদা বলতেন, আরে মিয়া ইয়ং পোলাপান, তোমাদের মতো বয়স থাকতে ঘটনার সঙ্গেসঙ্গে নিউজ লেখা শেষ করতাম। তোমরা কি করো? পরক্ষণেই মোলায়েম কণ্ঠে দাদার আকুতি- তুমি পাঠালে নিউজটা আবার ইংরেজী করতে হবে ভাই। এরপর আমি জমা দেব। একটু তাড়াতাড়ি দিও।
পুনশ্চ :বিভাস দা, আপনি বাবার বয়সী। অনেক সময় আপনার কথা রাখিনি, রাখতে পারিনি। ডিবি পিআর আফিসে বসে দুষ্টমি করেছি অনেক। দাদা ক্ষমা চাচ্ছি এখন- যদি ভুল করে থাকি, ক্ষমা করবেন আমাকে, আমাদের।
১২ মে, ২০১২