চিন্তার মুক্তি ও নাস্তিকতা

কাওসার জামান
Published : 6 March 2015, 10:21 AM
Updated : 6 March 2015, 10:21 AM

ঈশ্বরে বিশ্বাস নিয়ে যারা তর্কে লিপ্ত তারা ভাবে না যে, বিজ্ঞান যদি ঈশ্বরের অস্তিত্বহীনতার প্রামাণিক সুত্র উপস্থাপন করতে পারে তবে আস্তিকদের কথামালা অকেজো হয়ে যাবে। একইভাবে বিজ্ঞান মহাবিশ্ব ও প্রাণের উৎপত্তি বিষয়ে সঠিক ধারণা দিতে না পারলে নাস্তিকতাও ভিত্তি পাবে না।

যাই ঘটুক না কেন, সত্যকে ধারণ করা ছাড়া শেষ পর্যন্ত মানুষের কোনো উপায় থাকে না। মুক্তচিন্তা সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার পথ চিহ্নিত করবে। কিন্তু ধর্মীয় গোড়াদের সাথে তাল মিলিয়ে ধর্ম ত্যাগকারীরাও কেন স্থুল সব ব্যাপারে সর্বস্ব বাজি ধরে তর্কে জড়াচ্ছে?

পৃথিবীকে সমস্যা ভারাক্রান্ত করে তুলেছে নিয়ন্ত্রক পুঁজিবাদী অপশক্তির হাজারো কুট-কৌশল। যে ব্রিটেন বাকি দুনিয়ায় মানবাধিকার রক্ষার জন্য চিৎকার করে সেই ব্রিটেনই ব্লাসফেমি অর্থাৎ ধর্ম অবমাননা আইনের প্রবর্তক, নিরীহ মানুষ খুনের সহযোগী।

জঙ্গি লাদেনের সন্ধানে আমেরিকা লাখো অসহায় মানুষকে খুন করলো। সেই লাদেনকে আমেরিকাই তৈরী করেছে, ব্যবহার করেছে মুক্তচিন্তার মানুষদের বিরুদ্ধে। তালেবান জঙ্গিরাও আমেরিকার সৃষ্ট। মুক্তচিন্তার মুল শত্রু তাই এ পশ্চিমা দানব, ধর্ম নয়। এ অপশক্তি ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।

কার্ল মার্ক্স শোষণের অন্যতম অস্ত্র হিসেবে ধর্মের কথা বলেছিলেন বটে। কিন্তু সেটা ধর্মের নিজের বৈশিষ্ট্যের জন্য নয়, বুর্জোয়া শ্রেণী ধর্মকে শোষিত মানুষদের বিরুদ্ধে কাজে লাগায় বলে। ধর্মের এ অপব্যবহার যাতে দীর্ঘায়িত না হয় সেটাই ছিল মার্ক্সের চাওয়া।

সাম্রাজ্যবাদী শোষকদের নানাবিধ অপকর্মের ভিতর থেকে চিন্তার মুক্তি ঘটাতে হলে নির্ভীক ও নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গীর মালিক হতে হবে। নয়তো সত্যকে, নির্যাতিতের দাবীকে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে না। ঈশ্বরের উপর কারোর বিশ্বাস থাকা না থাকা প্রকৃতপক্ষে এখানে প্রাসঙ্গিক নয়।

মানুষের প্রথম পরিচয় – সে মানুষ। মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী কি ধর্ম পালন করতে পারে? ধর্মের স্বার্থেই মানুষের মানবীয় মুল্যকে গুরুত্ব দিতে হবে। মানুষকে ধর্মের গিনিপিগ বানানো বা তার মানবীয় মর্যাদা খাটো করে কোনো কিছু চাপিয়ে দেয়া যাবে না।

ইসলামের বিপক্ষে কটূক্তিকারীদের শাস্তি দেয়ার ব্যাপারে ফতোয়া দানকারীরা কোন্ যোগ্যতায় নিজস্ব অভিমত দিচ্ছে? সুস্পষ্ট ঘোষনা হল, ইসলামী আইনের প্রয়োগ হবে কুর্‌আন ও হাদিস অনুযায়ী। রাসুল যা করেছেন, বলেছেন তাই হবে ইসলামী বিধানের মাপকাঠি।

সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মুসলিমরা কেমন আচরণ করবে নবী তাঁর কর্ম দিয়ে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। তিনি নিজে কটূক্তির সম্মুখীন হয়েও শত্রুকে পাল্টা আঘাত করেন নি। তাহলে এক্ষেত্রে তার অনুসারীদের ভিন্ন কিছু করার সুযোগ কই?

জানতে হবে, ধর্ম আসলে কী বলেছে। তাহলে কুচক্রীরা ভুল ব্যাখ্যা দিতে পারবে না। কুর্‌আন ও হাদিসে নেই এমন বিষয়ে স্বীকৃত দায়িত্বশীলরা অতীতে যে সিদ্ধান্ত দিয়ে গেছেন সেগুলির সমষ্টি হল ইজমা। কুর্‌আন, হাদিস ও ইজমায় যা আলোচিত হয় নি সে বিষয়ে সমাধান খোঁজে কিয়াস।

কিয়াসে মত প্রদানকারী হতে হলে ধর্মীয় জ্ঞানের পাশাপাশি নির্দিষ্ট বিষয়ে সত্যিকারের বিশেষজ্ঞ হতে হবে, ব্যক্তি জীবনে ইসলাম ও মানবতার পূর্ণ প্রকাশ থাকতে হবে। ঐ ফতোয়াবাজরা কি সেভাবে যোগ্য? তাছাড়া কটূক্তির ব্যাপারে কী করতে হবে নবী সেটা বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। তাহলে এটা কিয়াসভুক্ত হয় কীভাবে?

আবার কিছু ঈশ্বর অবিশ্বাসী ক্ষুদ্রতার বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে না। দৃষ্টি আকর্ষন করা বা ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারই এদের মূল উদ্দেশ্য। অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে স্বেচ্ছায় অপরিণত শব্দ ব্যবহার করে জঙ্গিদের হুমকির মুখে পড়া আর শেষে পশ্চিমা দেশগুলিতে বসবাসের সুযোগ লাভ করাই এদের অনেকের চাওয়া।

বিজ্ঞান এখনো বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি বিষয়ক কোনো ধ্রুব ও চিরন্তন তত্ত্ব জানাতে পারে নি। আলোচিত বিগ ব্যাং থিওরিকে এর প্রবক্তা হকিং নিজেই বাতিল করে দিয়েছেন। তাহলে নাস্তিকতা কীভাবে বিজ্ঞানমনস্ক দর্শনের অপরিহার্য উপাদান হয়?

বিজ্ঞান যতদিন সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে অপরিবর্তনীয় বিকল্প সত্য জানাতে না পারবে ততদিন যার ইচ্ছে সে ধর্মকে শেষ কথা বলে মানতে চাইলে তাতে বাঁধা দেয়ার যুক্তি কোথায়? বিজ্ঞানের অপরাগতা কি মানুষের মনের স্বাধীন ইচ্ছেকে আটকে রাখার কারণ হতে পারে?

নিজের মত প্রকাশ করার অধিকার যেমন সবাই রাখে তেমনি মানুষকে তার নিজস্ব বিশ্বাস নিয়ে থাকতে দেয়াটাও যেকোনো বিচারে মানবিক।