সীমান্ত চুক্তি: বড় অর্জন

কাওসার জামান
Published : 9 May 2015, 06:35 PM
Updated : 9 May 2015, 06:35 PM

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রয়েছে ৪,০৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ স্থল সীমান্ত যা পৃথিবীর পঞ্চম দীর্ঘতম স্থল সীমান্ত। সুদীর্ঘকাল থেকে এটি ছিল বিরোধপূর্ণ, চরম জটিল ও সমস্যাসঙ্কুল এক সীমান্ত।

ছিল বলছি এ কারণে যে, স্থল সীমান্ত চুক্তি এখন সব ধাপ অতিক্রম করে বাস্তবায়িত হওয়ার পথে। এ সীমান্তের প্রতিটি বিন্দু এখন স্থায়ীভাবে যথাযত চিহ্নিত ও মীমাংসিত। ফলে বাংলাদেশ তার নিজস্ব ভুমির প্রতিটি কণায় সার্বভৌমত্বের অধিকার প্রয়োগের চিরস্থায়ী সুযোগ পেয়েছে।

আর এটি সম্ভব হয়েছে স্বাধীনতার মহানায়ক, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু ও তার যোগ্য মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সার্বিক তৎপরতা, উদ্যোগ, নেতৃত্ব, দৃঢ়তা ও ঐকান্তিক ইচ্ছার কারণে।

তাই বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি বঙ্গবন্ধুকে, অভিনন্দন জানাচ্ছি শেখ হাসিনাকে। মুক্তিসংগ্রামে বিজয়, স্বাধীনতা অর্জন, মাতৃভাষা দিবসকে বৈশ্বিকীকরণ, সমুদ্র বিজয় ও সীমান্ত চুক্তি করে দেশের আয়তন বাড়ানো – সবই এ দু'জনের অবদান।

বঙ্গবন্ধুই ১৯৭৪ সালে ভারতের সাথে এ স্থল সীমান্ত চুক্তিটি স্বাক্ষর করেছিলেন। বাংলাদেশের সংসদে তখনই এ চুক্তি পাশ হয়ে গিয়েছিল। এরপর ছিল বাস্তবায়নের পালা। কিন্তু কিছু কাপুরুষ রাতের আঁধারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে সে প্রক্রিয়া থামিয়ে দেয়।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ক্ষমতা দখলকারী সামরিক শাসকরা এ চুক্তি বাস্তবায়নের কথা ভারতকে বলার সাহসই করে নি কখনো যদিও ভারত নিয়ে দেশের ভিতর নোংরা রাজনীতি করে তারা ফায়দা লুটেছে।

ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নেয়া বিএনপির নেত্রী খালেদার ভাবনায়ও সীমান্ত সমস্যার বিষয়টি কখনো ছিল না। স্বৈরাচারী স্বামীর মতো সেও শুধু নির্বাচনকালে ভারত ইস্যু নিয়ে খেলেছে, ধর্ম ও ভারত জুজুর ভয় দেখিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে।

কিন্তু শেখ হাসিনা দেশের মানচিত্রের রূপরেখা সুনির্দিষ্ট করতে ও অপদখলীয় ভূমি উদ্ধার করতে উঠে-পড়ে লেগেছিলেন। সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন করা ছিল তাঁর বড় চাওয়া। ২০১১ সালের ৬ই ডিসেম্বর ঢাকায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের উপস্থিতিতে স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়।

সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে হাসিনার সরকার যে নিরলস ধারাবাহিক প্রচেষ্টা চালিয়েছে, যেভাবে ভারতের উপর অব্যাহত চাপ প্রয়োগ করেছে তারই দরুন চুক্তিটি এখন চুড়ান্ত সাফল্য অর্জন করেছে।

এ চুক্তির ফলে প্রধানতঃ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত ও চুড়ান্ত হবে, বাংলাদেশের আয়তন বাড়বে, বাংলাদেশের অপদখলীয় ভূমি উদ্ধার হবে, ভারতের সাথে যে অচিহ্নিত সীমানা ছিল তা চিহ্নিত হবে আর ছিটমহলের অধিবাসী ৫১,৫৮৪ জন আদম সন্তান মানবেতর জীবন যাপন করা থেকে মুক্তি পাবে।

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে সমস্যার মূলে ছিল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ১৬২টি ছিটমহল। ছিটমহল হল এক দেশের সীমানার মধ্যে থাকা আরেক দেশের ভূখন্ড। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এ বিরল জটিলতার উদ্ভব হয়েছিল কুচবিহার ও যশোরের দুই ভূমিদস্যুর খাম-খেয়ালিপণায়, অনেক যুগ আগে।

মুঘলরা এ সমস্যার সমাধান করতে পারে নি, ব্রিটিশরা সমাধান করার বদলে সমস্যাকে আরো জটিল করে রেখে গেছে আর পাকিস্তানিরা সমাধানের পথ খুজে পায় নি।

বাংলাদেশের সীমানার ভিতরে রয়েছে ভারতের ১১১টি ছিটমহল এবং ভারতের সীমানার ভিতরে রয়েছে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল। এমনকি বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে থাকা ভারতের এক ছিটমহলের ভিতরে আবার আছে বাংলাদেশের এক ছোট ছিটমহল।

বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের মোট আয়তন ৭,১১০.০২ একর। আর ভারতের ১১১টি ছিটমহলের মোট আয়তন ১৭,১৬০.৬৩ একর। সীমান্ত চুক্তির ফলে বাংলাদেশ পাচ্ছে ভারতের ঐ ১৭,১৬০.৬৩ একর ভূমি আর ভারত পাচ্ছে বাংলাদেশের ঐ ৭,১১০.০২ একর ভূমি। অর্থাৎ বাংলাদেশ ১০,০৫০.৬১ একর ভূমি বেশি পাচ্ছে।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তে ২৫টি অপদখলীয় ভূখণ্ডের দখল নিয়ে ভারতের সাথে বাংলাদেশের বিরোধ ছিল। চুক্তির ফলে এ ভুখণ্ডগুলির ২,৭৭৭.০৩৮ একর পাবে ভারত আর ২,২৬৭.৬৮২ একর পাবে বাংলাদেশ। তবে এ ২,২৬৭.৬৮২ একর ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের দখলে আছে।

চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ পাচ্ছে সর্বমোট ১৯,৪২৮.৩১২ একর ভূমি। অন্যদিকে ভারত পাচ্ছে সর্বমোট ৯,৮৮৭.০৫৮ একর ভূমি। অর্থাৎ চুক্তির ফলে বাংলাদেশের আয়তন প্রায় ১৫ বর্গ মাইল বা ৩৯ বর্গ কিলোমিটার বেড়ে যাচ্ছে।

সীমান্ত চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ মানবিক তাৎপর্য হল, ছিটমহলবাসীরা সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিকের মর্যাদা পাবে, তাদের বঞ্চনা ও বন্দিত্বের অবসান হবে। তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ইত্যাদি সুবিধা ভোগের অধিকার লাভ করবে।

ভারতের আইনসভার উভয় কক্ষ সর্বসম্মতিক্রমে সীমান্ত চুক্তিটি পাশ করেছে। চুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সেখানে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের ব্যাপক প্রশংসা করে দীর্ঘক্ষণ বক্তব্য দেয়া হয়েছে।

রাজ্যসভার এক অবাঙ্গালী সদস্য রাজ্যসভায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রেরণামূলক গান 'শোন একটি মুজিবরের কণ্ঠ থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে উঠে রণি….বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ' গেয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময়কে স্মরণ করে আবেগে কেঁদেছেন।

ভূমি হারানোর ইস্যুকে কেন্দ্র করে ভারতীয় রাজনীতিতে যখন সীমান্ত চুক্তি বিরোধী সুর উঠেছিলো তখন সোনিয়া ও মোদিই তা সামাল দিয়েছেন, বিরোধীদের বলেছেন – ছিটমহলগুলির উপর ভারতের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না বলে ভূমি হারানোটা প্রকৃতপক্ষে কোনো ক্ষতি নয়।

প্রশংসা প্রাপ্য আমাদের সরকার ও শেখ হাসিনার। ধন্যবাদ প্রাপ্য ভারতীয় সরকার ও রাজনৈতিক দলসমূহের, বিশেষ করে কংগ্রেসের। তারা সবাই আন্তরিক ছিলেন বলেই চুক্তিটি বাস্তবায়িত হচ্ছে।

লোকসভায় সীমান্ত চুক্তি পাশের পর শেখ হাসিনাকে ফোন করে নরেন্দ্র মোদি বলেন, ১৯৭৪ সালের ১৮ই মে আপনার পিতা বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে যে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন, আজ আপনার সরকারের সময় সেই মে মাসেই সেই বিলটি পাস হলো।

স্মরণ করা দরকার যে, যার হাতে ধরে আমাদের এ সাফল্য অর্জিত হয়েছে সেই শেখ হাসিনার উপর গ্রেনেড হামলা করেছিল খালেদার হাওয়া ভবনের বাসিন্দারা, তাকে হত্যা করতে গিয়ে খুন করেছিল ২৪ জন নিরীহ মানুষকে।

যারা নিজেরা দেশের কোনো অধিকার আদায় করতে পারে না, বরং দেশের সম্পদ লুটে-পুটে খায় আর ভারত গিয়ে ভারতীয়দের কাছে বাংলাদেশের দাবির কথা বলতে ভুলে যায় সেই খালেদা গংরা শেষ করে দিতে চেয়েছিল শেখ হাসিনাকে যিনি দেশের অধিকারগুলি একের পর এক আদায় করে যাচ্ছেন।

অন্ধকারের এ জীবদেরকে সমুচিত শিক্ষা দেয়া তাই জরুরী হয়ে পড়েছে।