অধার্মিকদের ‘ধর্মচর্চা’

কাওসার জামান
Published : 17 Nov 2015, 08:33 AM
Updated : 17 Nov 2015, 08:33 AM

শুরুতে প্রাসঙ্গিক একটি গল্প বলে নেই। এক আইএসআইএস সদস্য অস্ত্র হাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে এক খ্রিস্টান দম্পতির গাড়ি আটকিয়ে তাদের জিজ্ঞেস করলো, 'তোমরা কি মুসলিম?' খ্রিষ্টান লোকটি গাড়ির ভেতর থেকে উত্তর দিল, 'হ্যাঁ, আমি একজন মুসলিম।' তখন আইএসআইএস সদস্য বললো, 'তাহলে কোরানের একটি আয়াত পাঠ করে শোনাও।' খ্রিষ্টান লোকটি তৎক্ষণাৎ বাইবেলের একটি লাইন আওড়ালো। তা শুনে আইএসআইএস জংগি ঐ খ্রিষ্টান দম্পতিকে ছেড়ে দিল।

মুক্তি পেয়ে এসে খ্রিস্টান লোকটির স্ত্রী তার স্বামীকে বললো, 'তুমি মিথ্যা বলে ঝুঁকি নিতে গেলে কেনো? যদি ধরা পড়তে?' উত্তরে লোকটি বললো, 'ধরা পড়ার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। এ জংগিরা যদি কোরান পড়তো তাহলে তারা কখনোই মানুষ খুন করতো না। কারণ কোরান বলেছে, একজন নির্দোষ মানুষকে হত্যা করা মানে পুরো মানবজাতিকে হত্যা করা।'

মানুষাকারের নৃশংস প্রাণি আইএসআইএস জংগিরা নরহত্যা চালিয়ে যাচ্ছেই। প্যারিসে তাদের জংগি আক্রমণের শিকার হয়ে খুন হয়েছে শতাধিক নির্দোষ মানবসন্তান। এ মানুষগুলির অনেকে কনসার্টের গান শুনছিল, কেউ রেস্টুরেন্টে বসে খাচ্ছিল আর কেউ রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। এ 'অপরাধে'র দরুন তাদেরকে জীবন দিতে হয়েছে ৭ দ্বিপদী পশুর কাপুরুষোচিত আক্রমণের বলি হয়ে।

এ পাশবিক হত্যাকান্ড, এ জাংগলিক আক্রমণ, এ নির্মমতার সাথে কি কোনোভাবে ইসলামকে মেলানো যায়? ইসলাম তার যে বীরদের কীর্তিগাঁথা গেয়েছে তাদের কেউ কখনো এমন কোনো অমানবিক আক্রমণে অংশ নেন নি। মুসলিম নয় – শুধু এ কারণে কোনো নিরীহ মানুষকে খুন করা যাবে বলে কি ইসলাম কোথাও উল্লেখ করেছে? বরং কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। তাহলে কেনো বর্বরতার এ প্রদর্শনী?

এর একমাত্র কারণ এ জংগিদের পিছনে যে লোভী জানোয়াররা রয়েছে তাদের হাতকে শক্তিশালী করা। কারা এরা? জংগিরা 'কাফির'দের বিরুদ্ধে লড়াই করছে বলে দাবি করলেও তাদের পিছনের শক্তি মূলত: 'কাফির'রাই। ভুল নয়, সত্যি কথা। আইএসআইএস, আল কায়দা কিংবা তালেবান – এ ৩ জংগি গ্রুপেরই জন্মদাতা ও পৃষ্টপোষক হল আমেরিকান পুঁজিবাদীরা যারা সাধারণ জংগিদের ভাষায় কাফির।

প্রতারণাটা এখানে স্পষ্ট। প্রতারণা করা হচ্ছে মানবতার সাথে, সাধারণ মানুষদের সাথে, ইসলামের সাথে, সাধারণ মুসলমানদের সাথে। আমেরিকা লাদেনকে দিয়ে আল কায়দা ও হেকমতিয়ারকে দিয়ে তালেবান নামের জংগি দল তৈরী করিয়েছিল তার শত্রু রাশিয়ার বিপক্ষে ব্যবহার করার জন্য। আর আইএসআইএস বর্বরদের সৃষ্টি করেছিল আমেরিকার স্বার্থবিরোধী সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি হাফিজ আল আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে।

'কাফির' আমেরিকার ঐ পরিকল্পনার অংশ হয়ে মহান ধর্ম ইসলামের নাম ব্যবহার করে অবিকশিত মস্তিস্কের অধিকারী এ জংলিরা আজ দুনিয়াজ্যড়ে মানবিকতাকে, নিরীহ মানুষদের জীবনকে এবং ইসলামকে চরম বিপন্ন করে তুলেছে। ইসলাম যে মানবতার পতাকাবাহক ধর্ম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল তা কি এখন কোনো অমুসলমান বিশ্বাস করবে? এখন অমুসলমানরা কি এটা শুনে হাসবে না যে, ইসলাম শব্দের অর্থই হল শান্তি?

জংগিদের নির্মম আক্রমণে প্রিয়জনদের হারিয়ে অমুসলমানদের মনে যে ইসলামবিরোধী মনোভাব তৈরী হয়েছে তা কি আর কখনো দূর হবে? কোনো অমুসলমান কি এরপর বিশ্বাস করবে যে, ইসলামের নবী চরম নির্যাতিত হয়েও শত্রুদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন? জংগিদের বর্বরতার ফলশ্রুতিতে বিশ্বময় সাধারণ মুসলমানরা বর্তমানে যেভাবে হেনস্থা হচ্ছে তা কি কখনো বন্ধ হবে?

ধর্মের আবির্ভাব যেখানে শান্তি প্রতিস্টার জন্য, মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধন দৃঢ় করার জন্য সেখানে যারা ধর্মের মুখোশ পরে মানুষের অস্তিত্বকেই হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে তারা কি ধর্মদ্রোহী নয়? কারোর জীবনযাপনকে অজুহাত বানিয়ে তাকে শাস্তি দেয়ার দায়িত্ব কি এ মুর্খদের? আল্লাহ্‌ কি তাহলে পরকালে মানুষের পাপ-পুণ্যের বিচার করবেন না? মৃত্যুর পরের জীবনে দুনিয়ার কর্মকান্ডের হিসাব দিতে হবে – ধর্মের এ দাবি তাহলে ঠিক নয়?

আল্লাহ্‌ যে মুসলমান-অমুসলমান সব মানুষকে পৃথিবীতে স্বাধীনভাবে নিজ নিজ জীবন অতিবাহিত করার সুযোগ দিয়েছেন এসব হত্যাকান্ড কি সে বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে না? আল্লার চাওয়ার বাইরে গিয়ে যা খুশি তা করার অনুমতি কে দিয়েছে এ জংগিদের? কোরান কি অমুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলে নি "তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম?" কিংবা মদীনা সনদে কি ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা উল্লেখ করা হয় নি?

তাছাড়া নিজের বিশ্বাস অনুযায়ী জীবনযাপন করা যদি কারোর অপরাধ হয়েও থাকে তবুও সে অপরাধের শাস্তি কি তাকে দেয়া যায়? ধর্ম কি বলে নি যে, পৃথিবীতে যে যা করছে তা অবশ্যই আল্লার ইচ্ছায় করছে? বিকৃত মানসিকতার কিছু দু'পেয়ে জীব শাস্তি দেয়ার দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে কি আল্লার ঐ ইচ্ছাকে চ্যালেঞ্জ করছে না? আর আল্লার ইচ্ছাকে যারা প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করে তাদেরকে ধর্মের সেবক বলার সুযোগ কোথায়?

যে আল্লাহ্‌ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছেন বলে ধর্ম দাবি করে সে আল্লাহ্‌ কীভাবে তাঁর সেরা সৃষ্টি মানুষের এমন করুণ মৃত্যু চাইতে পারেন? আল্লাহ্‌ যে তা চান না তার প্রমাণ তিনি বলেছেন, একজন নির্দোষ মানুষকে হত্যা করা মানে পুরো মানবজাতিকে হত্যা করা। লক্ষণীয় ব্যাপার, আল্লাহ্‌ পুরো মানবজাতির কথা বলেছেন, শুধু মুসলিম জাতির কথা বলেন নি। অর্থাৎ আল্লাহ্‌ সব মানুষকেই রক্ষা করার কথা বলেছেন।

এ বর্বরোচিত হামলার হোতারা তাদের নিহত খুনিদের প্রশংসা করে বলেছে, "ভীতি সঞ্চার করার যে লক্ষ্য তোমাদের ছিল সাহসিকতা দেখিয়ে তোমরা তা অর্জন করেছো।" এ নিম্নবর্গীয় প্রাণিরা জানে না যে, শত্রুকে জানিয়ে সমান সুযোগ দিয়ে সামনাসামনি যুদ্ধ করাই হল সাহসিকতা, পিছন থেকে অতর্কিতে গুলি করে নিরীহ নারী-পুরুষকে হত্যা করা সাহসিকতা নয়, কাপুরুষতা।

আইএসআইএস জংগিরা যে আমেরিকার সাজানো আক্রমণে ধ্বংস হবে না তা বলা বাহুল্য। আমেরিকা তাদের সৃষ্ট জন্তু আইএসআইএসকে টিকিয়ে রাখতে চাইছে। যে আমেরিকা সম্পূর্ণ বিনা কারণে ইরাকের মতো সমৃদ্ধশালী বিশাল একটি দেশকে মাত্র কয়েকদিনেই ধুলোর সাথে মিশিয়ে দিল সে আমেরিকা ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের আক্রমণের মুখে থেকেও কীভাবে একটা জংগি সংগঠন দিনের পর দিন এত শক্তিশালী হয়ে উঠে? এটাই কি সব বলে দেয় না?

পৃথিবীতে মানব প্রজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে আইএসআইএস, আল কায়েদা, তালেবান, জামাত-শিবির, শিবসেনা, বিজেপি, আরএসএস, জিউস ডিফেন্স লীগ, ইরগুন, কু ক্লুক্স ক্লান, ক্যাথলিক রিঅ্যাকশন ফোর্স সহ সব জংগি সংগঠনকে অবশ্যই সমূলে বিনাশ করতে হবে। এবং যত যাই হোক, একদিন এগুলি ধ্বংস হবেই। এজন্য পুঁজিবাদী অপশক্তির বাইরে সারা বিশ্বে যে শুভশক্তি রয়েছে তার যথাশীঘ্র সম্ভব সক্রিয় হয়ে উঠা অপরিহার্য।

কোনো মানুষের জীবনই অন্য কোনো মানুষের ইচ্ছায় পরিচালিত হওয়ার জন্য নয়। অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে এর অন্যথা করা শুধুই পাশবিকতা। মানুষের মানবীয় পরিচয় তার ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়ে অনেক বেশি বড়। সেটাকে গুরুত্ব দেয়াই আসল ধর্ম।