অবচেতন মন ও রঙিন ভুল

কাওসার জামান
Published : 8 June 2016, 06:40 PM
Updated : 8 June 2016, 06:40 PM

সেদিন আকাশ ছিল মেঘলা। মনটাও ছিল দু:খে দ্রবীভূত। মা-বাবা ও ছোট বোনটিকে ছেড়ে পড়াশোনা নামক অতি প্রয়োজনীয় কাজের খাতিরে আমাকে ভিন্ন শহরে বাস করতে হচ্ছিল। ব্যাপারটা আমার বেলায় সহজ ছিল না। বুকের মাঝে এ বেদনা পাহাড় হয়ে চেপে বসেছিল।

প্রিয়জনদের একবারও না দেখে একটা দিন পার করা তখন আমার কাছে নিদারুণ কষ্টের কাজ ছিল। আমি নীরবে প্রতিনিয়ত সেই বেদনার নীলে নীলাভ হচ্ছিলাম। অবশ্য আব্বা যখন নিয়ম করে দিনকয়েক পরপর আমাকে দেখতে যেতেন তখন তাঁর কাছে আমি আমার এ বেদনাকে কখনো প্রকাশ করি নি।

নোট তৈরী করবো বলে সেদিন কলেজে যাই নি। রুমমেটরা সব ক্লাসে। কবে আবার মা-বাবার কাছে ফিরে যাবো একা আমি আনমনা হয়ে শুধু তাই ভাবছিলাম। মায়ের মায়াভরা চোখ দু'টি আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিলো। মাত্র সপ্তাহ দুয়েক আগে বাসা থেকে ঘুরে এসেছি। তাই প্রাইভেট পড়াকে এড়িয়ে সহসা আবার বাসায় ফিরে যাওয়ার উপায় ছিল না।

সেই উদাসী দুপুরে বাড়ি ফিরে যাওয়ার একমুখী চিন্তার ফাঁকে ফাঁকে অজান্তে অন্য কিছু দৃশ্যও বিদ্যুৎ চমকের মত মনের আয়নায় প্রতিফলিত হয়েছে তবে সেগুলি এতই ক্ষণস্থায়ী ও প্রভাবহীন ছিল যে আমাকে বিষণ্ণতার গ্রাস থেকে মুক্ত করতে পারে নি।

যেমন অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ নোট তৈরীর কাজ তখনও শেষ করতে না পারা, ক্লাসের যে মেয়েটি আমার দিকে লুকিয়ে লুকিয়ে তাকায় তার মুখ, ফাইনাল পরীক্ষার তারিখ দ্রুত এগিয়ে আসা, গ্রামের বাড়ির পার্শ্ববর্তী খালে ছোটবেলার সেই দুরন্ত নৌকা বাওয়া ইত্যাদি।

প্রকৃতি নিশ্চয়ই দু:খবোধ থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে রাখতে তার নিজস্ব পদ্ধতিতে এসব স্বরণ করিয়েছে। কিন্তু কোনোকিছুই আমার বেদনাকে লাঘব করতে পারে নি। বারবারই মনে হচ্ছিল, যদি তখনই একবার মায়ের কাছে ছুটে যেতে পারতাম! কিন্তু তা করার কোনো সুযোগ ছিল না।

না, উপায় হয়ে গেল অভাবিতভাবে অপরিহার্য এক কারণে! সরকারী সিদ্ধান্তানুযায়ী, দেশের সব কলেজ তখন নতুন প্রতিস্টিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চলে যাবে। আমাদেরও তাই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আবার রেজি:স্টেশন করতে হবে। রুমমেটরা কলেজ থেকে ফিরে এসে জানালো যে, আগামী ৩ দিনের মধ্যে এ রেজি:স্টেশন প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে বলে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে।

আমার জন্য এ খবর ছিল একই সাথে চমকের ও আনন্দের। চমকের কারণ এ প্রক্রিয়ায় এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা পাশের মূল সনদ দেখানোর প্রয়োজন হয় কিন্তু আমার ঐ সনদ দু'টি আমার কাছে ছিল না, ছিল বাসায় অর্থাৎ সিলেটে আর আমি তখন অন্য শহরে। এদিকে সময় আছে মাত্র ৩ দিন। আবার আনন্দের কারণ সনদ দু'টি আনতে আমাকে বাসায় যেতে হতে পারে।

সহজ সমাধান ছিল, ফোন করে আব্বাকে জানিয়ে দেয়া। তিনি সনদগুলি পাঠিয়ে দিতেন। আমি তা করি নি। বাসায় যাওয়ার এমন সুযোগ হারানোর কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না। তাই ঘন্টাখানিকের ভিতর সিলেটের ট্রেনে উঠে পড়লাম। রাতে বাসায় পৌঁছে আম্মাকে জানালাম যে, সনদগুলি নিয়ে যেতে হবে। আম্মা নির্দেশ দিলেন যেন রাতেই ঐগুলি ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখি।

পরদিন ভোর ৭.৩০ টায় আমার ফিরে যাওয়ার ট্রেন। নাস্তা খেতে বসার পর আব্বা-আম্মা দু'জনই জিজ্ঞেস করলেন সনদগুলি নিয়েছি কি না। আমি জানালাম, নিয়েছি। নাস্তা খেয়ে উঠে সনদগুলি হাতে নিয়ে ব্যাগে ঢুকাতে গিয়ে ভাবলাম, এগুলি ব্যাগে ঢুকাবো না, যে A4 সাইজের খামে ছিল সেটাতে রেখে হাতে করে নিয়ে যাবো। তাই খামটি ব্যাগের পাশে রেখে দিলাম। কিছুক্ষণ পর বিদায় নিয়ে ব্যাগ হাতে বেড়িয়ে পড়লাম।

গন্তব্যে পৌঁছানোর নির্দিষ্ট সময় ছিল দুপুর ১.১৫। কিন্তু যাত্রাপথের প্রথম স্টেশন পেরিয়ে কিছুদূর এগুনোর পরই ট্রেনটি হঠাৎ থেমে গেলো। বাংলাদেশের আন্ত:নগর ট্রেনগুলির সাথে লোকাল ট্রেনের খুব একটা পার্থক্য নেই বলে এরকম কিছু ঘটা স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। তাই শুরুতে এ নিয়ে মাথা ঘামাই নি। আমাকে ঘিরে ছিল মা-বাবাকে ছেড়ে আসার দু:খ।

জানলাম যে, সামনে কোথাও আরেকটি ট্রেন লাইনচ্যূত হয়েছে। ওটাকে সরানোর পর আবার আমাদের ট্রেন চলবে। সরানোর কাজ শুরু হয়েছে, আরো ঘন্টাদুয়েক লাগবে। আমাদের ট্রেনটি এমন এক জায়গায় থেমেছিল যেখান থেকে বিকল্প ব্যবস্থার আশ্রয় নেয়া মানে অনেকদূর হাঁটা, রিক্সায় চড়া ও বাসে উঠার ঝামেলায় যাওয়া। আমার ইচ্ছে হয় নি তা করার। দেখলাম, অধিকাংশ যাত্রীই আমার মতো অপেক্ষা করছে।

বই পড়তে পড়তে আর ট্রেনের ভিতরে ও বাইরে হাঁটাহাঁটি করতে করতে আবিষ্কার করলাম, ট্রেন ৩ ঘন্টারও বেশি সময় ধরে দাঁড়িয়ে আছে। যে কোনো সময় ছেড়ে দেবে এ আশা অবশ্য ত্যাগ করা যাচ্ছিল না। অবশেষে থেমে যাওয়ার ৫ ঘন্টা পর ট্রেনটি আবার চলতে শুরু করলো। শেষ পর্যন্ত দুপুর ১.১৫ টার পরিবর্তে সন্ধ্যা ৬ টায় গন্তব্যে পৌঁছলাম। ট্রেন থেকে নেমেই মাথায় হাত।

যে সনদগুলি আনার জন্য বাসায় যাওয়া সেগুলিই আমার সাথে নেই। না, ট্রেনে ফেলে আসিনি। মনে পড়লো, ওগুলি বাসায়ই রেখে এসেছি। সনদগুলি যে খামে ছিল বাসা থেকে বেরুনোর সময় তাড়াহুড়ায় সে খামটি আর হাতে নেই নি, শুধু ব্যাগটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি আর ভেবেছি, খামটি ব্যাগে আছে। নিজেকে যথেষ্ট অভিশাপ দিয়ে করনীয় নিয়ে ভাবলাম।

হাতে সময় আছে মাত্র ২ দিন। পরদিন যদি রেজি:স্টেশন প্রক্রিয়ার সব ধাপ শেষ করতে না পারি তবে আর শুধু ১ দিন সময় পাবো। অবশ্য বাসায় ফোন করে সনদগুলি আনিয়ে নিতে পারি। কিন্তু তা করলাম না। কারণ এ অবস্থায় আব্বার চলে আসার সম্ভাবনা বেশি। আব্বাকে কষ্ট দিতে চাই নি। নিজেই আবার বাসায় গিয়ে সনদগুলি নিয়ে আসবো বলে ঠিক করলাম।

তাই আবারো সিলেট অভিমুখে রওয়ানা হলাম। বাসায় পৌঁছলাম মধ্যরাতে। তখনো সেলফোন সেবা চালু হয় নি। আমাকে ফোনে সরাসরি পাওয়ার সুযোগ ছিল না বলে আব্বা-আম্মা উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছিলেন কখন আমি ফোন করি, সনদগুলি যে বাসায় রয়ে গিয়েছিলো। পরদিন ভোরে উঠে আবার যাত্রা। এদিনের ট্রেন অবশ্য সময়মত পৌঁছেছিল। কলেজে গিয়ে ঐদিনই রেজি:স্টেশনের কাজটি শেষ করে ফেললাম।

লেখাটি আমার একান্ত ব্যক্তিগত স্মৃতিকে কেন্দ্র করে রচিত। তবে লেখার উদ্দেশ্য অতীত স্মরণ করা নয়, অবচেতন মনের প্রভাব নিয়ে কিছু বলা। অবচেতন মনের অস্তিত্ব নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হল, এর কি ব্যবহারিক রূপ আছে? এটা কি অনুঘটক হিসেবে কোনো ঘটনা সংঘটনে ভূমিকা রাখতে পারে? এর নির্দেশনা কি বাস্তবের পূর্বানুমান? নাকি এ শুধুই কাকতালীয় যোগাযোগ?

যেদিন আমি গৃহকাতর হয়ে খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম ঠিক সেদিনই কীভাবে আমার বাড়ি যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হলো? আবার অভাবনীয় এক ভুলের ফলে কীভাবে একবারের জায়গায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দু'বার বাড়িতে যাওয়ার হেতু তৈরী হলো? একি শুধুই ভুল? এমন নয় যে, সনদগুলি আনার জন্য আগে বা পরে এমনিতেই আমার বাড়ি যেতে হতো।

নতুন করে রেজি:স্টেশন করতে হবে এবং তার জন্য সনদগুলি লাগবে – এ জানাই ছিল। সবারই ধারণা ছিল, এজন্য যথেষ্ট সময় দেয়া হবে। সে অনুযায়ী আমিও ভেবে রেখেছিলাম সময় হলে কুরিয়ারের মাধ্যমে সনদগুলি আনিয়ে নেব। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ আকস্মিকভাবে ভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে ঐদিনই আমার বাড়ি যাওয়ার প্রয়োজন হল।

আবার সনদগুলি রেখে আসার মতো ভুলটাই বা কেমনে হল? পরিচিতজনেরা আমার স্মৃতিশক্তির প্রশংসায় যথেষ্ট সরব। তবে আমি জানি যে, আমি প্রায়ই জরুরী কাজ করতে ভুলে যাই। কিন্তু ঐদিন যে পরিস্থিতিতে যেভাবে ভুলটি করেছি আগে বা পরে আর কখনো তেমন কিছু করি নি। তাই ব্যাপারটি আমার কাছে বিস্ময়কর।

অবচেতন মনের ক্ষমতায় আস্থা স্থাপনের কোনো ইচ্ছা আমার নেই। তবে এটা বলা যায় যে, দু'টি ভিন্ন ঘটনা অদূর ভবিষ্যতে পরস্পরকে কীভাবে প্রভাবিত করবে আমাদের অদৃশ্য অনুভূতি হয়তো ঘটনাগুলি ঘটার অব্যবহিত পূর্বে তা বুঝে নেয়। জীবনের নানা রহস্যময়তার উত্তর খুঁজতে গিয়ে সম্ভবত: এটাকেই আমরা অবচেতন মনের তৎপরতা বলে চিহ্নিত করি।

অবশ্য যেখানে জীবন কী ও কেনো তাই সঠিকভাবে জানা যায়নি সেখানে অবচেতন মন নিয়ে কি আর বেশি কিছু বলা যায়?