জাকির নায়েক বিতর্কের অন্যদিক

কাওসার জামান
Published : 10 July 2016, 08:00 PM
Updated : 10 July 2016, 08:00 PM

দুনিয়াব্যাপী ইসলাম বিশ্লেষক হিসেবে বিখ্যাত ড: জাকির নায়েক বর্তমানে খুব আলোচনায় আছেন। তিনি কোনো ভুল করে থাকলে সেটাকে ভুল বলা যেমন সঠিক হবে তেমনি তাঁর অহেতুক সমালোচনাকেও মেনে নেয়া সহজ হবে না।

গত ১লা জুলাইয়ের গুলশান আক্রমণের পর থেকে জাকির নায়েক ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছেন। কেনো? ঐ আক্রমণে অংশ নেয়া জঙ্গিদের একজন কয়েক মাস পূর্বে তার ফেসবুক ওয়ালে জাকির নায়েকের একটি উক্তি পোস্ট করেছিল, তাই।

এছাড়াও সন্দেহভাজন জঙ্গি হিসেবে ভারতে আটক কিছু ছেলে ফেসবুকে জাকির নায়েককে অনুসরণ করেছে বলে ভারত সরকার জানিয়েছে। এর ভিত্তিতেই নাকি নায়েকের কর্মযজ্ঞকে তদন্তের আওতায় আনা হয়েছে, তাঁকে নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব এসেছে।

কোনো জঙ্গি তার ফেসবুক ওয়ালে জাকির নায়েকের উক্তি পোস্ট করেছে বা ফেসবুকে তাঁকে অনুসরণ করেছে বলে ঐ জঙ্গির অপকর্মের দায় জাকির নায়েকের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তাঁকে নিষিদ্ধ করার কথা ভাবা বালখিল্যতা নয় কি?

সাম্প্রতিককালে যেসব অমুসলমান সিরিয়াল কিলার নরওয়ে বা আমেরিকায় শতাধিক নিরীহ নারী-পুরুষকে বিনা কারণে গুলি করে খুন করেছে তারাও ফেসবুকে অনেককে অনুসরণ করেছে। এ খুনগুলির দায় কি তবে সেসব অনুসরণীয় ব্যক্তিদের উপর বর্তানো হয়েছে?

গুলশান ও শোলাকিয়া হত্যাকাণ্ড এবং ব্লগার রাজিব খুনে জড়িতদের অনেকে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলো। তাই বলে কি ঐ বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধ করে দিতে হবে? এ লেখা লিখতে লিখতেই জানতে পারলাম যে, বাংলাদেশে পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানোর কোনো কারণ আছে কি?

কেউ যদি সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতা উস্কানোর কাজে লিপ্ত হয় তবে প্রমাণসাপেক্ষে তাকে নিষিদ্ধ করা যেতেই পারে। কিন্তু নিছক নিজের ধর্মীয় বিশ্বাসকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে যুক্তিনির্ভর পন্থায় মিডিয়া ব্যবহার করে প্রচার করা কীভাবে সাম্প্রদায়িক উস্কানি বলে গণ্য হয়?

ড: নায়েক সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতাকে উৎসাহ দিয়ে কি কখনো কিছু বলছেন বা করেছেন? এমন কিছুর প্রমাণ কি কেউ কখনো দিতে পেরেছে? যদি তিনি তেমন কিছু করতেন তাহলে কি ভারতের মতো সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে জর্জরিত দেশে এত দীর্ঘ সময় ধরে তাঁর কর্মকাণ্ড চলতে পারতো?

খৃস্টান ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ভারতীয় উপমহাদেশে তাদের ধর্মসমুহ প্রচার ও রক্ষা করতে গিয়ে যেসব জঘন্য অপকর্ম করেছে সেগুলি তো বেশি পুরানো ঘটনা নয়। মাত্র ১০০ বছর আগেও খৃস্টান মিশনারিরা অর্থ, খাদ্য ও কাজ ইত্যাদির লোভ দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইলিং করে অনেক দরিদ্র ভারতীয়কে খৃস্টান বানিয়েছে। এসবে সফল না হলে অত্যাচার করেছে।

আর ব্রিটিশ বেনিয়াদের সেবাদাস হিন্দু জমিদাররা হিন্দুত্ব রক্ষার নামে নিরীহ মুসলমানদের উপর যেসব অত্যাচার করেছে তা পশুদেরও হার মানায়। কোরবানির ঈদের নাম 'বকরা ঈদ' হওয়া হিন্দু জমিদার ও ধর্মপ্রচারকদের সাম্প্রদায়িক কুকর্মের একটি বড় উদাহরণ।

ঢাকার হিন্দু জমিদাররা গরু কোরবানি করা নিষিদ্ধ করে। পরে পুরো বাংলার হিন্দু জমিদাররা তাই করে, হিন্দু পুরোহিতদের পরামর্শে। যেসব মুসলমান এ নিষেধাজ্ঞা মানতে চাইতো না তাদের চরম নির্যাতন করা হতো। ফলে বাংলায় গরু কোরবানি দেয়া ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়, শুরু হয় ছাগল কোরবানি দেয়া। আর ঈদের নাম হয়ে যায় 'বকরা ঈদ'।

জাকির নায়েক কি এভাবে ধর্মপ্রচার করছেন? তিনি কি কখনো বলেছেন যে, হিন্দুরা মুর্তিপূজা করতে পারবে না? তিনি কি কখনো তাঁর অনুসারীদের নির্দেশ দিয়েছেন অমুসলমানদের হত্যা করতে? তিনি কি কখনো উল্লেখ করেছেন যে, গুলশান হত্যাকাণ্ডের মতো অপকর্মগুলি ধর্মচর্চার অংশ?

নিজের ধর্মবিশ্বাসে পাহাড়ের মতো অটল থেকেও তিনি অন্য ধর্মের প্রতি যথেষ্ট উদার। পিস টিভির এক অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী কয়েক হাজার দর্শকের উপস্থিতিতে ড: জাকির নায়েক ও ….. দেব নামক এক হিন্দু ধর্মপ্রচারক নিজ নিজ ধর্মের পক্ষে যুক্তি দিচ্ছিলেন, দর্শকদের প্রশ্নেরও উত্তর দিচ্ছিলেন।

অনুষ্ঠানের মাঝামাঝি পর্যায়ে এক মুসলমান দর্শক ঐ হিন্দু ধর্মপ্রচারককে অনেকটা ব্যঙ্গ করে একটি প্রশ্ন করেন। প্রশ্নটি ছিলো – "হিন্দুদের জনৈক দেবতা কীভাবে মায়ের গর্ভে থাকাকালীন সময়ে মায়ের কথা শুনতে পেল?" হিন্দু ধর্মপ্রচারক দেববাবুর পক্ষে এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব হয় নি।

বরং নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে গিয়ে তিনি ঐ দর্শকের উপর ক্ষেপে যান, 'আপনি বেশি বুঝে ফেলেছেন' বলে তাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেন। এমতাবস্থায় ড: জাকির নায়েক বলেন, "মায়ের গর্ভে অবস্থান করে মায়ের কথা শুনতে পারা সম্ভব কারণ বিজ্ঞান বলেছে – ৪ মাস বয়স থেকেই গর্ভস্থ শিশু মায়ের কথা শুনতে পায়।" তাঁর এ জবাবেই দেববাবু উদ্ধার পান।

এভাবেই জাকির নায়েক সত্য দিয়ে প্রতিপক্ষকেও সাহায্য করেছেন। সেই তাঁকে সন্ত্রাসের উস্কানিদাতা বলা কীভাবে সম্ভব? যত বড় জ্ঞানধারীই হোন না কেনো, সন্ত্রাসবাদী হলে তিনি কোটি কোটি সাধারণ মুসলমানের হৃদয় জয় করতে পারতেন না। তাঁর পিস টিভি পৃথিবীর ২০০টি দেশে বিভিন্ন ভাষায় প্রচারিত হয়। তাহলে তাঁকে নিষিদ্ধ করার কথা ভাবার যুক্তি কোথায়?

অন্যদিকে ভারতেরই হিন্দু মৌলবাদীরা সম্প্রতি বলেছে – ভারতে থাকতে হলে মুসলমানদেরকে হিন্দু হয়ে থাকতে হবে, মুসলমানদের সংখ্যা যাতে না বাড়ে সেজন্য তাদেরকে বাধ্যতামূলক জন্মনিয়ন্ত্রণের আওতায় আনতে হবে, কোনো হিন্দু মেয়ে কোনো মুসলমান ছেলেকে বিয়ে করলে তাকে যৌনকর্মী বলে গণ্য করা হবে ইত্যাদি। এ মৌলবাদীদের নিষিদ্ধ করা হয়েছে?

অন্যায়ের শিকার হলে, নির্যাতিত হলে তার প্রতিবাদ করা কি ভুল? পৃথিবীর প্রায় সব দেশের সব ধর্মের মানুষ ইরাকে ঈঙ্গ-মার্কিনীদের অন্যায় হামলার প্রতিবাদ করেছে। এ সাম্রাজ্যবাদী হামলার শিকার হয়ে ১০ লাখ ইরাকী শিশু-নারী-পুরুষ অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। এটাকে জুলুম বলা কি সাম্প্রদায়িকতা?

আল কায়েদা কাদের সৃষ্টি? কে বানিয়েছে আইএস? আমেরিকা। আমেরিকা নিজ স্বার্থে বিকৃত মানসিকতার অধার্মিকদেরকে ইসলামের মুখোশ পরিয়ে ব্যবহার করছে। সিরিয়ার ক্ষমতা থেকে আসাদকে সরাতে আইএস জঙ্গিদের তৈরি করেছে, আফগানিস্তান থেকে রুশদের বিদায় করতে তালেবানদের তৈরি করেছে।

জাকির নায়েককে দায়ী করার তাই কোনো সুযোগ নেই। কেউ ইচ্ছেমতো ইসলামের অপব্যাখ্যা মনে গেঁথে নিয়ে নিজের অপুষ্ট মস্তিস্কের প্ররোচনায় অপকর্ম করলে তার দায়ভার তাকেই নিতে হবে, কোনো ধর্মপ্রচারককে নয়।