উপকারীর পিঠে ছুরি

কাওসার জামান
Published : 14 August 2016, 04:53 AM
Updated : 14 August 2016, 04:53 AM

যারা আশ্রয় দিলো, আহার দিলো তাদেরকেই যদি আশ্রয়প্রার্থী বিনা কারণে খুন করতে যায় তবে সেই আশ্রয়প্রার্থীকে মানুষ বলার কোনো কারণ অবশিষ্ট থাকে না। শুধু পাশবিক প্রাণিদের পক্ষেই সম্ভব উপকারীর জীবননাশ করা। এরা ধর্মের লেবাস পরে আগডুম-বাগডুম গাইলে কীই বা আসে যায়? ধোঁকাবাজি করে তো আর মানুষ হওয়া যায় না।

গত মাসে যে আফগান শরণার্থী ছেলেটি জার্মানির একটি ট্রেনে বন্যজন্তুর মতো আক্রমণ করে ৪ জন জার্মান নাগরিককে কুপিয়ে আহত করেছিলো সে ছিলো মাসকয়েক আগে জার্মানিতে আশ্রয় পাওয়া এক উদ্বাস্তু। যুদ্ধবিধস্ত ইরাক, সিরিয়া ও আফগানিস্তানের লাখো লাখো মুসলিম শরণার্থী যখন নিজেদের দেশ ছেড়ে এসে আশ্রয়প্রার্থী হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো তখন কোনো মুসলিম দেশ তাদেরকে আশ্রয় দেয় নি, সৌদিআরব তো তাদেরকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলো।

সেই অবস্থায় এ অসহায় মানবসন্তানদের গৃহ, খাদ্য ও কাজের সংস্থান করে দিয়ে নিজেদের দেশে আশ্রয় দেয় খৃস্টান জার্মানি ও ফ্রান্স, তাও শখানেক লোককে নয়, লাখো মুসলিম শরণার্থীকে, জার্মানি একদিনেই আশ্রয় দিয়েছিলো ৮,০০০ জনকে, ২০১৫ তে জার্মানিতে মোট ৯,৬৪,৫৭৪ জন শরণার্থী আশ্রয় পেয়েছে।

সেই জার্মানিরটা খেয়ে, জার্মানিতে বাস করে, জার্মানদেরকে খুন করছে এ শরণার্থীদের অনেকে!!!!! কেনো? জার্মানরা মুসলমান নয় বলে। মারহাবা! মুসলমান না হওয়াটা যদি পাপ হয় তাহলে ওদের কাছে গিয়ে আশ্রয় নেয়া কেনো? ওদের দান গ্রহন করা কেনো? শরণার্থীরা যখন আশ্রয় চেয়েছিলো তখন কি জার্মানরা খৃস্টান ছিলো না? মুসলমান না হওয়ায় ওদের খুন করা যদি জায়েজ হয়ে যায় তাহলে তো খৃস্টান না হওয়ায় মুসলমানদেরকে খুন করাও বৈধ হয়ে যাওয়ার কথা, যদি ধর্মই একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হয়।

যেখানে তথাকথিত কোনো মুসলিম দেশ এ শরণার্থীদেরকে আশ্রয় দিতে চায় নি, ইউরোপের অন্য দেশগুলিও তাদের দরজা বন্ধ করে রেখেছিলো সেখানে জার্মানি ও ফ্রান্স মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে সব বাধাকে উপেক্ষা করে এদেরকে আশ্রয় দিয়েছিলো। আর এ আশ্রিতরাই এখন জার্মান ও ফরাসিদের বুকে ছুরি বসাচ্ছে, একাধিকার আক্রমণ করেছে জার্মানিতে। অন্যদিকে জঙ্গিরা ফ্রান্সের অবস্থা ভয়াবহ করে তুলেছে দিনকয়েক পরপর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে। উপকারের কী দারুণ প্রতিদান!

হাঙ্গেরী ও পোলান্ডের মতো যে দেশগুলি এ শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে রাজি হয় নি তারা এখন জার্মানি ও ফ্রান্সকে বলছে – এবার বুঝেছো তো কেনো আমরা এদের আশ্রয় দিতে চাই নি? লক্ষণীয় ব্যাপার, যারা আশ্রয় দিয়েছে সেই জার্মানি ও ফ্রান্সে একের পর এক বর্বরোচিত হামলা করে গেলেও যারা তাড়িয়ে দিয়েছে সেই হাঙ্গেরী বা পোলান্ডে কোনো আক্রমণ করে নি জঙ্গি শরণার্থীরা।

নিশ্চিতভাবেই আশ্রয়গ্রহণকারী অধিকাংশ শরণার্থী নিরীহ ভালোমানুষ, বিনা দোষে ভোগান্তিতে পড়ে আজ তারা দেশান্তরী। বেঁচে থাকার জন্য মাথা গোঁজার ঠাঁই আর কাজ পেয়েই তারা খুশি। ধর্মের মুখোশ পরে মানুষ খুন করা কখনোই তাদের চাওয়া নয়। তবে তাদের মধ্যেই রয়ে গেছে ধর্মব্যবসায়ী জঙ্গিদের কিছু অনুচর। এরাই বেহেশতে যাওয়ার আশায় এমনকি আশ্রয়দাতাকেও খুন করছে। এরপর কেউ যদি ধর্মকে কিংবা ধর্মের অনুসারীদেরকে খারাপ মনে করে তাকে দায়ী করা যাবে কি?

শুধু নির্দিষ্ট কোনো এক ধর্ম নয়, সব ধর্মমতের অনুসারীরাই সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় নিচ্ছে। ধর্ম যে আফিমের মতো তা আজ পদে পদে প্রমাণিত হচ্ছে। অন্যের বিন্দু পরিমাণ অধিকার খর্ব করাই যেখানে অন্যায় সেখানে বিনা প্ররোচনায় নিরীহ সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নেয়া কিংবা উপকারীর জীবনহরণ করা কেমন জঘন্য মহাপাপ তা বলা বাহুল্য।

স্বর্গে যেতে চাওয়া বা পরজনমে অভিশপ্ত হতে না চাওয়া দ্বিপদী প্রাণিরা বিপরীত বিশ্বাসে বিশ্বাসীদের, গরুর মাংস খাওয়া মানুষদের খুন করছে। পরকালে বা পরজনমে নিজেদের 'মুক্তি'র জন্য ইহকালে বা ইহজনমে অন্যের প্রাণনাশ করা, মানবিক অধিকার খর্ব করা এদের কাছে পরম আকাঙ্ক্ষিত ব্যাপার। এটাই নাকি ধর্মের 'চাওয়া'! আহারে ধর্ম!

নিজেদের জীবনে মানবতা, সততা, বিনয়, সহমর্মিতা ও সভ্যতার কোনো ছোঁয়া লাগতে দেয় নি অথচ অন্যের জীবন কেড়ে নিয়ে, অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে এরা নাকি স্বর্গে যাবে!

ধর্মচর্চার ফল যদি এই হয় তাহলে ধর্মের অস্তিত্বই কি প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে পড়বে না? কেনো কেউ ভাববে না কী দরকার ধর্মসমুহের?