ট্রেনের টিকেট, স্যালুট ও ঘুষ কাহিনী

কাওসার জামান
Published : 3 Sept 2016, 04:10 PM
Updated : 3 Sept 2016, 04:10 PM

ঘটনাটি ৯/১১ এর সময়কালীন। হাইকোর্টের এক বিচারপতি সিলেট এসেছিলেন। কাজ শেষে ঢাকায় ফিরে যাওয়ার জন্য ট্রেনের টিকেট কাটতে গিয়েছিলেন রেলস্টেশনে। টিকেট না পেয়ে তিনি এতই গোস্বা করেন যে, ঢাকায় ফিরে গিয়েই ঐ স্টেশনের টিকেট কাউন্টারের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারের আদেশ জারি করেন এবং তাদের গ্রেফতার করানও। অভিযোগ – এরা ট্রেনের টিকেট বিক্রি নিয়ে দুর্নীতি করেছে।

এর বছরকয়েক পরের ঘটনা। উচ্চ আদালতের এক বিচারপতি গাড়ি করে ঢাকার কোনো এক রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে তার গাড়ি রাস্তায় দায়িত্ব পালনরত এক ট্রাফিকপুলিশকে অতিক্রম করে। ব্রিটিশ বেনিয়াদের চালু করে যাওয়া নিয়মানুযায়ী সেই পুলিশের নাকি কর্তব্য ছিলো বিচারপতির গাড়ি দেখেই হাত কপাল বরাবর ভাঁজ করে পা দিয়ে মাটিতে জোরে এক লাথি মেরে শব্দদূষণ বাড়িয়ে দেয়া।

যানজটের নারকীয় যন্ত্রণা সামলাতে ব্যস্ত থাকা ঐ ট্রাফিকপুলিশ তা করতে ভুলে যান। এতে ঐ বিচারপতির মর্যাদাবোধে এতই আঘাত লাগে যে, কর্মস্থলে ফিরে গিয়ে তিনি শুধু সংশ্লিষ্ট ট্রাফিকপুলিশের বিরুদ্ধেই সমন জারি করেননি, পুলিশের আইজিকেও আদালতে তলব করেন। পুলিশের প্রধান ক্ষমা চাওয়ার পর ট্রাফিক পুলিশের ঐ লোক রেহাই পান।

সম্প্রতি এক বিচারপতির স্ত্রীর নিকট হতে ঘুষ গ্রহণ করায় পুলিশের এক এএসআইকে চাকুরি থেকে অপসারণ করা হয়েছে। সাময়িক বরখাস্ত নয়, অভিযোগ পাওয়ার পরপরই একেবারে অপসারণ। যেখানে কোন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে খুন-ধর্ষণের অভিযোগ উঠার পরও তাকে সাময়িক বরখাস্ত করতেই কর্তৃপক্ষ গড়িমসি করে সেখানে এমন কিছু করা মহল বিশেষকে বিশেষ খাতির করারই নামান্তর।

ট্রেনের টিকেট নিয়ে দুর্নীতি করা কিংবা ঘুষ খাওয়া যে মারাত্মক অপরাধ এবং এ অপরাধগুলি যে দেশে মহামারির আকারে বিদ্যমান তা সর্বজ্ঞাত। তবে সাধারণ মানুষেরাই এসব অপকর্মে বেশি ভুগছে। তারা কি এসবের প্রতিকার পাচ্ছে? নিজেদের নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হলে তার বিরুদ্ধে নিজেরাই ব্যবস্থা নেয়া তো তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

জনগণের অধিকারের রক্ষক হিসেবে রাষ্ট্রের বেতনভোগী বিচারপতিরা কি এক্ষেত্রে পরিপূর্ণভাবে দায়িত্ব পালন করছেন? তাদের কাজ কি নিজেদের ব্যক্তিগত অধিকার আদায় করা পর্যন্তই? আইনের আশ্রয় নিয়ে নিজের অধিকার প্রতিষ্টা ও ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সুযোগ কি শুধু বিচারপতিদের জন্য?

সাধারণ জনগণের এ সুবিধা ভোগ করার ব্যাপারটি শুধু আইনের বইয়েই লিপিবদ্ধ থাকবে? রাষ্ট্র তো জনগণের জন্য, জনগণই এর সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক। সেই জনগণের সেবায় নিয়োজিত হয়ে জনগণের দুর্দশাকে ভুলে থাকা কি ন্যায়পরায়ণতার ভিত্তি হতে পারে?

এদেশের সরকারী অফিসগুলি থেকে ঘুষ প্রদান ব্যতীত মানুষ কোনো সেবা পায় না। যে বিচারপতির স্ত্রীর নিকট থেকে ঘুষ নেয়ায় ঐ এএসআইয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে সেই বিচারপতি কি একবারও ভেবেছেন যে, প্রতিদিন যে হাজার হাজার মানুষ এমন বিড়ম্বনায় পড়ে কষ্ট পাচ্ছে তাদের জন্য তিনি কী করেছেন?

সিএ পড়তে গিয়ে একসময় আমাকে বেশকিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানের হিসাব নিরীক্ষা করতে হয়েছে, সেগুলোর কর্মকাণ্ড চাক্ষুষ করতে হয়েছে। সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভয়াবহ দুর্নীতি, অনিয়ম, ফাঁকিবাজি, স্বজনপ্রীতি, ইউনিয়নবাজি আর আইনকেই ব্যবহার করে সেসব হজম করিয়ে নেয়ার যে অন্ধকারতম রূপ আমি দেখেছি তা ভাষায় রূপ দেয়া কঠিন।

সরকারি অফিসগুলির এ অবস্থা কি বিচারপতিদের জানা নেই? আদালতের কার্যক্রমের সাথে জড়িত পুলিশ বিভাগ হচ্ছে দুর্নীতি-অনিয়মের অন্যতম পীঠস্থান। অন্যকিছু থাক, এ বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত করতে, এর সেবাকার্যে আমূল পরিবর্তন আনতে কোনো বিচারপতি কি কখনো কোনো রুল জারি করেছেন? নির্দেশনা দিয়েছেন? অথচ নিজেরা ভুক্তভোগী হলে ঘন্টাখানেক সময়ও লাগে না ব্যবস্থা নিতে।

বিচারপতি হিসেবে অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী না হয়ে কাজ করে যাওয়ার যে শপথ নিতে হয় এটা কি তার সাথে যায়? আরেকটা ব্যাপার, একজন বিচারপতি যতক্ষণ আদালতে থাকেন শুধু ততক্ষণই তিনি বিচারপতি হিসেবে মর্যাদা পাওয়ার অধিকারী। আদালতের বাইরে তার ব্যক্তিগত সত্ত্বাকে বিচারপতি হিসেবে মূল্যায়ন করতে বাধ্য করা কি অমানবিকতা নয়?

একইভাবে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জনগণের সেবা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যে আইনের দ্বারা সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকুরি নিয়ন্ত্রিত হয় তাতে তাদেরকে সরাসরি Public Servants বা জনগণের চাকর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই জনগণের চাকর হিসেবে তাদের যে দায়িত্ব তার অন্যথা করা মানে নিজেদের মানুষ পরিচয়কে বিতর্কিত করা।

নিজেরা ভুক্তভোগী হওয়ার পর ব্যবস্থা নেয়া ভুল কিছু নয় কিন্তু যাদের সেবা করার নামে বেতন ভোগ করা তাদের দুর্দশায় নীরব থাকা মোটেই ঠিক নয়।