শিল্পের সঙ্গে লড়তে হলে, শিল্প দিয়ে লড়ো

কৌশিক ভট্টাচার্য
Published : 10 Sept 2015, 11:06 AM
Updated : 10 Sept 2015, 11:06 AM

ভাবতে অবাক লাগে, ভাবলে রাগ হয় যখন শিল্পীর গায়ে হাত পরে। সে ভারত হোক কি বাংলাদেশ। যখন কয়েকজন জবরখাকি ধর্মের নামে নখ-দাঁত বার করে শিল্পীদের
আঁচড়ে কামড়ে দেশ থেকে বের করে দেয়। যখন হিন্দু জবরখাকিরা 'হুসেন কেন আমাদের দেবীর নগ্নমূতি এঁকেছে' বলে মুণ্ড চাইছিল কিংবা মুসলিম জবরখাকিরা 'তসলিমা
ওর লেখায় মুসলমান ধর্মের অপমান করেছে অতএব ওর মুণ্ড লাও' বলে ফতোয়া দেয়, তখন ভারত বা বাংলাদেশ সরকার কেন রুখে দাঁড়িয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠে বলতে পারে না,
'শিল্পের কিছু বুঝিস না, একদম চুপ করে থাক' বা 'শিল্প অপছন্দ হলেই শিল্পীকে ঠ্যাঙানো যায় না, ওটা চূড়ান্ত অসভ্যতা।' আসলে ভোট বড় বালাই।
এসবের মূলে রয়েছে একটাই জিনিস – ধর্ম। যা গোঁয়ার্তুমি আর অশিক্ষার টুনি বাল্ব জ্বেলে বসে আছে। এই শ্রেণীর লোকেদের কোনও কাজ নেই। সকাল বিকেল বিড়ি ফুঁকছে
আর কার পেছনে কাঠি দেওয়া যায় সেই মতলব ভাঁজছে। জীবনের গ্লানি, ব্যর্থতা, হেরে যাওয়া, বদহজম, অপূর্ণ সেক্স, খিদে সব মিলিয়ে এদের বুকের ভেতর একটা
চিড়বিড়ে বিষের থলি তৈরি হয়। সে বিষ ঢালতে না পারলে নিজেকেই জ্বালিয়ে মারে। যারা কুড়ে, তারা এ বিষ ঝাড়তে বউকে পেটায় বা নেড়ি কুকুরের সঙ্গমের সময় যৌনাঙ্গে
টিপ করে ইট ছোঁড়ে। আর যাদের এনার্জি আছে,তারা একটা মারকুটে সংগঠন খুলে ফ্যালে। যে সংগঠন বেশি পড়েনি, বেশি বোঝে না, বেশি ভাবাকে অস্বাস্থ্যকর মনে করে।
এরা রোজ জপে, চ শালা, ধর্মের নামে একটা অজুহাত বাগিয়ে, কিছু লোককে জানে মেরে দিই। সে হাতে হোক বা বোম মেরে হোক বা প্লেন হাইজ্যাক করে কোনও বড়
বাড়িতে ধাক্কা মেরে হোক। এদের আদর্শ হিংসা। কর্মপ্রণালী খুন-খার। অ্যাজেন্ডা মানুষ মারা। এবার সংগঠনগুলো-তো আর সরাসরি বলতে পারে না, আমাদের মানুষ মারতে
খুব ভাল লাগে। কারন, আমাদের এমনি কিছু করার নেই, কিন্ত ভেতরটা অলটাইম নিশপিশ করে।
এখানে কিন্ত হিন্দু জবরখাকি আর মুসলিম জবরখাকির কোনো ফারাক নেই। এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমি থাকতে ওকে দেখলি ক্যানে? সব জবরখাকি সমান শয়তান
সমান কুঁদুলে, সমান খতরনাক। এরা মনে করে তারা সমস্ত হিন্দু বা মুসলিমের ইজারা নিয়ে নিয়েছে। এদের ধারনা ঠাটিয়ে ইট-পাটকেল ছুঁড়তে পারলে এবং তরোয়াল নিয়ে
দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে যেতে পারলেই ধর্মকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা হয়। হিন্দু মাস্টার ভ্যালেন্টাইনের দিন প্রেম দেখলেই যুগলকে বেধড়ক পেটাচ্ছে, কারন প্রেম হিন্দু
সংস্কৃতির পরিপন্থী। মুসলিম সবজান্তারা শ্বশুরের কাছে ধর্ষিতা পুত্রবধূকে ঘাড় ধড়ে বাড়ির বাইরে ছুঁড়ে দিচ্ছে, কারন শরিয়ত অনুযায়ী ও-বউ আর স্বামীর সঙ্গে ঘর করতে
পারবে না। হিন্দু জবরখাকি বলছে, আমাদের বিধবারা হোলসেল পবিত্র,ওদের নিয়ে বেলাল্লা গপ্পো ফেঁদে সিনেমা করতে দেব না। মুসলিম গোঁয়ার বলছে,দেশের সব লোকের
জন্য সমান আইন-ফাইন আবার কী, আমাদের মেয়েরা খোরপোশ পাবে কিনা তা ঠিক হবে আমাদের ধর্মীয় অনুশাসন দিয়ে, সংবিধানে গুলি মার। হেভি চলছে। এই চালিয়ে
যাওয়াটা দরকারও বটে। কারন বসে বসে ক্যাডারগুলোর হাতে-পায়ে জং ধরতে দেওয়া যায় না। সামনে ভোট আসছে। এখন রক্ত চনচন না করলে, বাইসেপ ঠিকঠাক
এক্সারসাইজ না-পেলে, আসল সময় হয়তো ক্ষুর টানতে গিয়ে লেবড়ে গেল। তখন?
আরও একটা কথা, শিল্পের মিশন কোনোকিছুর শিকড় ধরে নাড়ানো, ঝাঁকানো। বাক-স্বাধীনতার মূল কথাটাই ঃ অ-পছন্দসই কথা বলার অধিকার। একমত না হওয়ার
অধিকার। চাড্ডি আপেল আর বেদানার স্টিল লাইফ আঁকার জন্য স্বাধীনতার দরকার হয় না। প্যান্টে হেগে ফেলা লোক ক্যানভাসে জ্বলজ্বলিয়ে আঁকার জন্য
স্বাধীনতার দরকার হয়। এসব দেখেশুনে তোমার খুব রেগে যাবার অধিকার আছে, তেমনই আমারও আলবাত অধিকার আছে তোমায় রাগিয়ে দেবার। আর হে গবাগাম্বু,
কারোরই এতটুকু অধিকার নেই মারধর বাগাবার। শিল্পের সঙ্গে লড়তে হলে, শিল্প দিয়ে লড়ো, শিক্ষিত তড়িকায় লড়ো। শিল্পের ইতিহাস, ভূগোল, জ্যামিতি, দশন একফোঁটা
জানো না, কিন্ত গলাবাজি করে শিল্পী কী আঁকবেন, লিখবেন তা তুমি ঠিক করে দেবে, সেটা হয় না বাবা।