শৈশব থেকে শুরু হয় বন্ধুত্ব। পাড়ার বন্ধু, স্কুলের বন্ধু, কলেজের বন্ধু। তারপর অফিসের কলিগ। তারাই হয়ে ওঠে বন্ধু। পুরনো বন্ধুত্ব মুছে যায়। নতুন বন্ধু আসে। সেই বন্ধুত্বও একদিন মুছে যায়। বোধহয় (তেমনিই দেখছি, উপলব্ধি করছি)। শেষ পর্যন্ত মানুষটা একা। সত্যিই কি তাই? আমি বন্ধু মনে করি তাদের – গনগনে এক চুল্লির ভেতর যাদের সঙ্গে হাত সেঁকতে পারি দিনরাত। যাদের কাছে আমার ভালো সাজার দায় নেই এতটুকুও-তারাই আমার বন্ধু। ফুৎকারে যারা উড়িয়ে দিতে পারে আমার কোনও মতামত। নিঃসঙ্কোচ সমালোচনায় যারা বিদ্ধ করতে পারে আমার সকল কারুকৃতি। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারে আমার ভুল-ত্রুটি। আমাকে কোনও
ভালো বলার দায় নেই যাদের একতিলও। আর হ্যাঁ, বন্ধু হবে তেমন, যে কিনা ভালুক দেখলে গাছে চড়ে বসবে না কখনও। একটা কথা খারাপ লাগলে যে কিনা ঠোঁট ফুলিয়ে আর সম্পর্ক রাখবে না কখনও। বন্ধুত্ব এতটাই ঠুনকো নাকি!
না আমি এজীবনে কোনও বলার মতো বন্ধু পাইনি। হয়ত আশেপাশে ছিল দেখতে পাইনি। কিংবা কাউকে চিনতাম অথচ বুঝতে পারিনি। হতে পারে অনেক কিছুই। হতে পারত অনেক কিছুই। কিন্তু আমি এমন বন্ধু পাইনি। আপনারা কেউ পেয়েছেন? বন্ধুত্বে কাল এবং সময় একটা খুব বড় ব্যপার। সময় দিয়েই বন্ধুত্বের আসল পরীক্ষা। মহাভারতে বন্ধু কেমন হবে বা হয় সে নিয়ে মহাকবি ব্যাসদেব অনেক কথা বলেও শেষে এক অস্পষ্ট দার্শনিকতা রেখে দিয়ে বলেছেন, " সখ্য কোনও অজর অমর বস্ত নয়, কাল বন্ধুত্বকে গ্রাস করে – ন সখ্যমজরং লোকে…কালো বৈনং বিহরতি।"
ঠিক এখানে অদ্ভত লাগে, যখন বিখ্যাত দার্শনিক জ্যকাস দেরিদা এক বৃহৎ সভায় এসে অ্যারিস্টটলের শব্দ উদ্ধার করে প্রথমেই বললেন,' My friends, there are no friend'. এক জব্বর অ্যারিস্টটলীয় উচ্চারণ – " ও আমার বন্ধুরা সব, এখানে কোনও বন্ধু নেই।" অ্যারিস্টটল বন্ধুকে একজন মানুষের দ্বিতীয় প্রতিফলিত আত্মা বলে মনে করেন। যা মহাভারতে অর্জুন আর কৃষ্ণের বন্ধুত্বের মধ্যে পাওয়া যাবে – যেমনটা কৃষ্ণ বলেছেন – অর্জুন আমার বাইরে থাকা এক প্রাণ, যে আমি সেই অর্জুন, যে অর্জুন সেই আমি – যো'হং তমর্জুনুং বিদ্ধি যো'র্জুনঃ সো'হমেব তু।
এখন তো এসমস্ত কথা আর কোনও অর্থ বহন করে না। এই জেটযুগে সবাই ছুটছে। নিজেকে নিয়ে, নিজের আত্মঅহংকার নিয়ে, নিজের ভাবনা-কথা-ঠিকভুল নিয়ে বাঁচে। বন্ধুত্ব এখানে বাসা বাঁধে না। এখন আবার বন্ধুত্ব আন্তর্জালিক। ফেসবুক-বন্ধুত্বের ঘনত্বের স্বাদ আইসক্রিমের মতো। জমাট থাকতে থাকতে না-খেলে গলে জল। আমার অভিজ্ঞতায়, যে কোনও সম্পর্কের মতোই বন্ধুত্বেরও দুটো ডাইমেনশন আছে। একদিকে যদি ভালোবাসা, ভালোলাগা, অন্তরঙ্গতা হয়, তবে তার উল্টোদিকে একটু নিন্দা, একটু পিএনপিসি, একটু গসিপ তো আছেই। ভালো-মন্দ মিলেমিশেই তো মধুর সম্পর্কের সূচনা হয়, তাই না? আপনারা কী বলেন?