আমরা শোকাহত কিন্তু সেই সাথে বিস্মিত

কাজী রাশেদ
Published : 25 Jan 2015, 06:50 PM
Updated : 25 Jan 2015, 06:50 PM

আমাদের জানামতে মৃত্যু সংবাদ মানুষের চিরশত্রুকেও কাছাকাছি এনে দেয়। এই বিশ্বাস আর ধ্যান ধারনা নিয়েই আমাদের বড়ো হওয়া, এটা আমাদের সামাজিক রীতিনীতিতে পরিনত হয়েছে। আমরা কারো মৃত্যু সংবাদে বিচলিত হয়ে উঠি সে আমাদের নিকটজন হোক বা না হোক।

গতকাল বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছোট ছেলে মালয়েশিয়ায় ইন্তেকাল করেছেন(ইন্না লিল্লাহে…রাজিউন)। স্বভাবতই সারাদেশের মানুষ কাছে এটি একটি শোকের সংবাদ। মৃত্যুসংবাদ প্রচারের সাথে সাথে সারাদেশের মানুষের আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায় তাঁর মৃত্যুসংবাদ। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তার মৃত্যুসংবাদ অত্যন্ত গুরুত্বের সাথেই প্রচার করতে থাকে।

মৃত্যু স্বাভাবিক, এটাই চিরন্তন সত্য। তারপরেও যেকোন মৃত্যু আমাদের নাড়া দিয়ে যায়। নিজের বেচে থাকাটা তখন নিজের কাছেই মুল্যবান হয়ে উঠে। তারপর আবার ভুলে যাই মৃত্যুর স্বাভাবিকতাকে।

গতকাল আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যু সংবাদে বিচলিত হয়ে উঠেন, আরেকজন মায়ের পুত্র বিয়োগের সংবাদে তিনি হয়ে উঠেন শোকাভিভূত। হোক উনি তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। তিনি এক সদ্য পুত্রহারা মায়ের কাছে সমবেদনা জানাতে ছুটে যান খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে, যেখানে বেগম খালেদা জিয়া অবস্থান করছেন গত আঠার দিন যাবত। প্রধানমন্ত্রী গুলশানে রওয়ানা হওয়ার প্রায় কয়েকঘন্টা আগে থেকেই ম্যাডামের অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্তদের সাথে যোগাযোগ করা হয়। এবং জানামতে সেই অফিস থেকে সবুজ সিগন্যালও দেওয়া হয়েছিলো যে প্রধানমন্ত্রী আসতে পারেন।

প্রধানমন্ত্রী গেলেন এবং কিছুক্ষন অপেক্ষা করে গেট থেকে ফিরে এলেন। বিশেষজ্ঞদের মতে প্রধানমন্ত্রীকে ফিরিয়ে দেওয়া কোনমতেই মেনে নেওয়া যায় না। এ বড়োই অমানবিক, বড়োই অসামাজিকতা। শেখ হাসিনা সঠিক কাজই করেছিলেন। আমাদের সমাজ, দেশ এবং সংস্কৃতি এটাই আশা করে। পুত্র শোকে বিহ্বল এক মায়ের কাছে আরেক মায়ের ছুটে যাওয়ায় কোন রাজনীতি বাধ সাধতে পারে না। কোন শত্রুতা বাধা হয়ে দাড়াতে পারে না।

প্রধানমন্ত্রীকে এই ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনায় সারা দেশের মানুষ বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়েছে। বিশিষ্ট জনেরা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন।

আরাফাত রহমান কোকো একজন সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামী। তিনি সাজাপ্রাপ্ত হবার পরে তিনি আজ পর্যন্ত দেশে ফিরে তার সাজার বিরুদ্ধে আপীল করেননি। সেমতে তিনি একজন দন্ডপ্রাপ্ত আসামী হবার পরেও প্রধানমন্ত্রী শুধুমাত্র বেগম খালেদা জিয়ার পুত্রশোকের বিহ্বলতায় পাশে যেয়ে দাড়াতে চেয়েছেন। মা হয়ে মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে পুত্র হারানোর শোকের ভাগীদার হতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু বিধিবাম, বাংলাদেশের রাজনীতির সংস্কৃতি যে সেভাবে গড়ে উঠেনি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে যখন পুত্র হারা শোকের মধ্যেও রাজনৈতিক বিরোধ প্রাধান্য পায় তখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক হানাহানি বন্ধের কোন সম্ভাবনাই নেই বললে চলে।

গতকাল সারা ঢাকা শহরের মানুষ আশা করেছিলো এবং আলোচনা করেছিলো যে, যেহেতু পুত্রের মৃত্যু সংবাদ এসেছে সেহেতু দেশবাসী হয়তো কিছুদিনের জন্যে হলেও অবরোধ, হরতাল, মানুষ মারার কর্মসূচী থেকে রেহাই পাবে। এখানেও আশার বাতিতে পানি ঢেলে দিয়ে অবরোধ এবং হরতালের কর্মসূচী প্রদান করলেন বেগম খালেদা জিয়া। শোনাযায় উনি পুত্র শোকে অসুস্থ্য, এটাই স্বাভাবিক এবং এই অসুস্থ্যতা এতোই তীব্র যে, প্রধানমন্ত্রী উনার গেট থেকে ফিরে গেছেন অথচ তিনি দেখা করতে পারেন নি। কিন্তু মানুষ মারা কর্মসূচী দেওয়ার সময় তিনি অসুস্থ্যতা বোধ করেননি। প্রতিদিন যে মানুষগুলো  আগুনে মারা যাচ্ছে, বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পরছে সেই মৃত্যুগুলি উনাকে স্পর্শ করলো না এটা ভাবতেই মানুষ হতবাক হয়ে যাচ্ছে। তারপরেও আমরা শোকাহত কিন্তু সেই সাথে বিস্মিত।