একুশে আমার, একুশে এখন সারা বিশ্বের

কাজী রাশেদ
Published : 14 Feb 2015, 07:04 PM
Updated : 14 Feb 2015, 07:04 PM

বাঙালির ইতিহাস সংগ্রাম আর আন্দোলনের হলেও বিজয়ের ইতিহাস হাতে গোনা। সেই বিজয় সূচিত হয়েছিলো '৫২ এর ভাষা আন্দোলনের বিজয়ের মধ্য দিয়ে। পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আন্দোলন হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধ হয়েছে দেশে দেশে। কালো সাদার বর্ণবাদ বিরোধে গৃহযুদ্ধের কথা স্মরন আছে আমাদের সবার। মানুষকে দাস করে রাখার বিরুদ্ধেও আন্দোলন হয়েছে অনেক দেশে। সে সব যুদ্ধ, আন্দোলন আর সংগ্রামের ইতিহাস আমাদের মানব জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার ইতিহাস। আমরা মানুষ হিসেবে সেইসব আন্দোলনের ইতিহাসের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা খুঁজে পাই, খুঁজে পাই অহংকারের যৌক্তিকতা।

পৃথিবীর এই এগিয়ে চলার ইতিহাসে নিজের মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ের জন্যে নিজের বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে ভাষা কে প্রতিষ্ঠা করার ইতিহাস বাংলাদেশের মানুষ প্রথম করে দেখিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে একটি পুরানো শোনা গল্প আবার বলতে বড় ইচ্ছে করছে। অনেকদিন আগে এক পত্রিকায় পড়েছিলাম এই গল্পটি। মনে নেই সেই পত্রিকাটির নাম। তবুও বলছি। এই গল্পটি আমাকে প্রেরনা যোগায়, গর্বিত করে।

মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বিদ্বান ভদ্রলোক চাকুরীর জন্যে সাক্ষাতকার দিতে গিয়েছিলেন। ইন্টারভিউতে নিয়োগ কর্তারা উনাকে প্রশ্ন করেছিলেন আপনার দেশের সবচেয়ে গর্বের ইতিহাস কী? ভদ্রলোক উত্তরে বলেছিলেন আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস। কারন আমাদের দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ত্রিশ লাখ মানুষ প্রান দিয়েছিলো, পাকিস্তানের  মতো একটি সুশিক্ষিত সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীন করেছে আমাদের দেশ। নিয়োগ কর্তা তার কথাকে পাত্তা না দিয়ে বলেছিলেন ভালো করে চিন্তা করে বলুন। ভদ্রলোক শেষ পর্যন্ত সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীকে সন্তুষ্ট করতে পারেন নাই।

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীদের মধ্য থেকে একজন তাঁর চোখ খুলে দিয়ে বলেছিলেন, সারা বিশ্বে বহু বিষয়ে আন্দোলন হয়েছে, যুদ্ধ হয়েছে, মানুষের অনেক আত্মত্যাগের ইতিহাস আছে যা বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যে দেশের মানুষ তাদের ভাষার জন্যে জীবন দিয়ে ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করেছে। এ গর্ব শুধুমাত্র তোমার জন্যে নয়, তোমার দেশের জন্যে নয়, এ গর্ব বিশ্বের প্রতিটি মানুষের। তোমরা এই একটি ঘটনাতেই সারা বিশ্বে মাথা উঁচু করে থাকবে।

একুশে আমাদের জীবনের সব কিছুতেই আত্মত্যাগের প্রেরণা নিয়ে আসে। তাই বাঙালি অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও এগিয়ে চলে তার অভিষ্ট লক্ষ্যে। গত ২০১৩ সালে সারা দেশ যখন রাজনৈতিক এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে বিপর্যস্ত হয়েছে সেই সময়েও বিশ্বব্যাংক সহ সকল বিশেষজ্ঞদের ধারনাকে ভুল প্রমানিত করে প্রবৃদ্ধির সূচককে উপরে নিয়ে গেছে। সাধারণ মানুষের পথচলাকে কোন আগুনে বোমা, ককটেলেই ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না। এই না পারার পিছনেও কাজ করে একুশের চেতনা। স্বাধীনতা আন্দোলনের মতোই ৫২'র ভাষা আন্দোলনও এদেশের সাধারন মানুষকে একাত্মবদ্ধ করেছিলো। সেদিন আজকের মতো এতো ইলেকট্রনিক মিডীয়া ছিলো না, ছিলো না এতো সংবাদ পত্রের ছড়াছড়ি। মানুষের চেতনাই কাজ করেছে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের মনে যারা আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিলো তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা উচ্চারিত হয়েছিলো।

আজ ৬৩ বছরে এসেও একুশ আমাদের কাছে এখনো প্রাসঙ্গিক, এখনো জেগে উঠার মন্ত্র, এখনো দ্রোহের আগুনে জ্বলে উঠার দিন।

বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাবে প্রতিষ্ঠা করার যে প্রত্যয় নিয়ে সালাম, রফিক, জব্বার আর বরকত সহ অনেক নাম জানা শহীদ প্রাণ দিয়েছিলো সেই কাজটি হয়তো পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা পায় নি। প্রতিষ্ঠা পায় নাই এখনো দেশের সকল ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহার করার কার্যকারিতা। কাগজে কলমে বাংলা ভাষা এখন রাষ্ট্রীয় ভাষা কিন্তু কার্যকারিতা নেই অনেক যায়গাতেই। এখনো বিচার ব্যবস্থা, উচ্চশিক্ষা, চিকিৎসা শাস্ত্রে ইংরাজীর বিকল্প তৈরী করা যায় নি। এই যে না করতে পারা সেটাও আমাদের আত্যাভিমানে আচড় কাটছে না। দুইজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত উদ্যোগ এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর তড়িৎ ব্যবস্থা ২১শে ফেব্রুয়ারী আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা রূপে জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে এই দিনটিকে যথাযোগ্য ভাবে উপস্থাপন করা, দিবসটি পালনে প্রচার প্রচারনায় যথেষ্ট তৎপরতা চোখে পরে না বললেই চলে।

আজ বিশ্বের বহু মাতৃভাষা বিপন্নের পথে। আমরা যে জাতি ভাষা প্রতিষ্ঠা করার জন্যে বুকের রক্ত দিতে কার্পণ্য করি নাই সেই জাতিকেই এই বিলুপ্তপ্রায় ভাষা গুলোকে রক্ষা করতে পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত যে আন্তর্জাতিক ভাষা ইনিস্টিটিউট তৈরী করা হয়েছে সেই সংস্থাটিকে এইসব বিলুপ্তপ্রায়ভাষা রক্ষা করার কাজে লাগেতে হবে। আর এই রক্ষা করার কাজের মধ্য দিয়ে আমরা একুশের গর্বকে আরো গৌরাবাম্বিত করতে পারবো।

একুশ মানে মাথা নত না করা। এই শিক্ষাই আমাদের সকল অপশক্তির বিরূদ্ধে, সকল জঙ্গী কার্যক্রমের বিরূদ্ধে লড়াই করার সাহস যোগায়। পেট্রল বোমা আর মানুষ মেরে বাঙালির চেতনাকে দমিয়ে রাখা যায় না, যাবে না। এবার একুশের শপথ হবে সকল নৈরাজ্যের বিরূদ্ধে, জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে, গনতন্ত্র উদ্ধারের নামে সাধারন মানুষকে পুড়িয়ে মারা বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর। সে যেই দল হোক সাধারন মানুষ আর কারো ক্ষমতায় যাওয়া আর আসার সোপান হবে না।