গনমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা বা উৎপাদন মুখী শিক্ষা ব্যবস্থার দাবীতে বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ সেই পাকিস্তান আমল থেকেই আন্দোলন চালিয়ে আসছে। ৬২'র শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে যে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিলো সেই আন্দোলনের জের ধরে ৬৪ সালেও ছাত্র আন্দোলন আবার দানা বেঁধে উঠে এবং আন্দোলনের মুল দাবীই ছিলো একটি গনমুখী বা উৎপাদন মুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার। উনসত্তরের ছাত্রসমাজের ঐতিহাসিক ১১ দফার মুল লক্ষ্যও ছিলো সেই একই দাবীর ভিত্তিতে।
যে শিক্ষাব্যবস্থা মানুষকে কেরানী তৈরী করে সেই শিক্ষাব্যবস্থা কে বাতিল করে উৎপাদনে কাজে লাগা এক শিক্ষা ব্যবস্থার দাবী ছিল ছাত্রসমাজের প্রাণের দাবী। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তাদের ব্যবসার প্রয়োজনে, তাদের শাসন ব্যবস্থাকে পাকা পোক্তভাবে গড়ে তুলতে ভারতীয় উপমহাদেশে তাদের অনুগত কেরানী সৃষ্টির উপযোগী এক শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন করে। লর্ড ম্যাকলের সেই কেরানী সৃষ্টির শিক্ষা ব্যবস্থা আজো আমাদের দেশে চালু আছে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশ স্বাধীন হলে সবাই মনে করেছিলো এবার ছাত্রসমাজের প্রাণের দাবী একটি গনমুখী বা উৎপাদন মুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হবে। দেশ স্বাধীন হবার পরে ডঃ কুদরতে এ খোদার নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে একটি সময়োপযোগী শিক্ষানীতি প্রনয়ন করার চেষ্টা হয়েছিলো। অনেক সীমাবদ্ধতা থাকলেও সেই শিক্ষা ব্যবস্থা ছিলো অনেকটা মন্দের ভালো।
দুর্ভাগ্যের বিষয় ৭৫ এর মর্মান্তিক ঘটনার পরে সামরিক শাসক যিয়াউর রহমান সেই শিক্ষা কমিশনকে হিমঘরে পাঠিয়ে নতুন এক শিক্ষা কমিশন তৈরী করে অন্য একটি শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলনের চেষ্টা করে। ৮১ এর পট পরিবর্তনে সেই শিক্ষা কমিশনও হিমঘরে চলে যায়। এরপরে স্বৈরাচারী এরশাদ সাহেব শিক্ষাকে পাকিস্তানী আমলের আদলে তৈরির লক্ষ্যে এক অদ্ভুত শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট পেশ করে। সেই শিক্ষা কমিশনকে ছাত্র সমাজ ঘৃণা ভরে প্রত্যাখান করে। এবং এক কার্যকরী ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলে।
স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সর্বদলীয় ছাত্রসমাজ যে আন্দোলন গড়ে তোলে সেই আন্দোলনেরও মুল লক্ষ্য ছিলো একটি উৎপাদনমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রনয়নের। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য ৯০ এর গণঅভ্যুত্থানের ২৫ বছর পার হয়ে গেলেও গনমুখী বা উৎপাদন মুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা যায় নি। আজোও সেই ব্রিটিশ আমলের কেরানী তৈরির শিক্ষা ব্যবস্থাই চালু আছে আমাদের এই স্বাধীন দেশে।
২০০৮ সালে শেখ হাসিনা সরকার আবার ক্ষমতায় এসে নতুন একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন এবং অনেক আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে একটি শিক্ষানীতি প্রয়োগের প্রয়াস শুরু করেন। এই শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন থাকলেও উৎপাদন মুখী কতটুকু তা বলার সময় এখনো আসেনি। তবে গত ছয় বছরে শিক্ষা কাঠামোর অনেক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। এই উন্নয়নের মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে যেসব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে তার একটি বিবরন নিচে দেওয়ার চেষ্টা করেছি।
সুত্রঃ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
আমরা এইসব উন্নয়ন মুলক কাজের পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর কাজ শুরুটা দেখতে পারছি। এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্ব পরিসরেও এসব কাজের প্রসংশা পাচ্ছে। কিন্তু তারপরেও ছাত্রসমাজের সেই প্রানের দাবী উৎপাদন মুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলনের দেখা মিলছে না বললেই চলে। যে শিক্ষা ব্যবস্থা একজন ছাত্রকে কাজের প্রতি, তার শিকড়ের প্রতি সম্মান দেখাতে শেখায় না সে শিক্ষা ব্যবস্থা সমাজকে কখনোই সামনে এইয়ে নিতে পারে না। এই দুর্নীতি পূর্ণ গোটা সমাজটাকে পাল্টাতে চাইলে প্রথমেই শিক্ষাব্যবস্থা পালটানো ছাড়া উপায় নেই।
আমরা এই শিক্ষা বান্ধব শিক্ষা মন্ত্রী এবং সরকারের কাছে একটি উৎপাদন মুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়নের দাবী জানাচ্ছি। আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে একটি মানুষ হবার শিক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে জেতে চাই। আর এই কাজটি আমরা মনে করি এই সরকারের পক্ষেই সম্ভব।