বাঙালির স্বপ্ন পূরণে একটি জন্ম!

কাজী রাশেদ
Published : 16 March 2015, 03:45 PM
Updated : 16 March 2015, 03:45 PM

ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহুকুমার দক্ষিন অঞ্চলের সর্বশেষ ইউনিয়নের মধুমতি নদীর কোল ঘেষে যে গ্রাম সেই টুঙ্গীপাড়া গ্রামে একটি শিশু জন্ম গ্রহন করে ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ। যেদিন পাড়াগাঁ টুঙ্গীপাড়ার শেখ বাড়িতে যখন শিশুটি জন্মগ্রহন করেছিলো সেদিন কোন সংকেত দেখে ছিলো কিনা বাড়ির বাসিন্দারা বা গ্রামবাসীরা জানা যায় নি। কিন্তু সবার অজান্তেই বাংলার ভাগ্যে এক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জন্ম নিয়েছিলো সেই অজপাড়া গাঁতে।

বাংলার ইতিহাসে অনেক লড়াই, বিদ্রোহ আর রাজা মহারাজার আগমন নির্গমনের ইতিহাস থাকলেও বাংলার সাধারন মানুষের মাঝ থেকে উঠে আসা কোন জননেতার ইতিহাস ছিল না। জননেতা থাকলেও তারা ছিলেন সবসময়ের জন্যেই উপেক্ষিত। টুঙ্গীপাড়ার শেখ সাহেব ছিলেন এখানেই ব্যতিক্রম। মওলানা ভাষানীর পরে একেবারে মাটির কাছ থেকে উঠে আসা কোন নেতার আগমন এই প্রথম। একেবারে স্কুল জীবন থেকেই স্কুলের, গ্রামের ছোট খাটো বাদ প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠা জনগনের নেতা হয়ে উঠার কাহিনী আমরা খুব কমই দেখেছি। বাংলাদেশের ইতিহাসে দেখা গেছে সামন্ত প্রভুরা বা তাদের সন্তানেরাই জনগনের উপর তাদের ক্ষমতার ছড়ি ঘুড়িয়ে জনগনের মতামতকে তোয়াক্কা না করেই জনগনের নেতা হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন। জনগণও তাদের উপর কখনো কথা বলেন নাই বা অমান্য করেন নাই। তবে হয়তো একারণেই মাঝে মাঝেই কৃষক বিদ্রোহ বা অসন্তোষের মাঝে পড়েছে সেইসব নেতা নেত্রীরা। ইতিহাসের কালের ধারায় হারিয়ে গেছেন অনেকেই।

বঙ্গবন্ধু ছোট বেলা থেকেই গ্রামের বা স্কুলের বা দেশের স্বাধীনতার জন্যে বিভিন্ন আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত করলেও নিজেকে নেতা হিসেবে কখনোই প্রতিষ্ঠিত করতে চান নাই। একজন একনিষ্ট কর্মী হিসাবে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন এবং মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। কলকাতার ভয়াবহ দাঙ্গায় মানুষকে বাঁচাতে সারা কোলকাতা জুড়ে কাজ করেছেন কোন কিছু পাওয়ার তোয়াক্কা না করেই। তাই বলে তিনি যে প্রথম থেকেই নেতা হয়ে নেত্রিত্ব দেখাতে পারতেন না এমন কিন্তু নয়। কারণ তিনি ইতিমধ্যেই ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অফিসিয়াল ছাত্রলিগের বিরুদ্ধে নিজের প্রার্থী দাঁড় করিয়ে জিতিয়ে এনেছিলেন কিন্তু নিজে কখনো প্রতিদ্বন্ধিতা করেন নাই বা নেতা হতে চান নাই। সেইসময় থেকেই সারা বাংলায় মুসলিম লীগের জেলা সন্মেলন ও কমিটি গঠনে ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং যারা শুধুমাত্র পদ আঁকড়ে ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে প্রার্থী দাঁড় করিয়ে জিতিয়ে এনেছিলেন। অথচ তখনো তিনি নিজের পদ পদবীর জন্যে লালায়িত হন নাই। এখানেই তাঁর হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হবার মাহাত্ম।

নিজের পড়াশুনা, ক্যারিয়ার, নাবালক স্ত্রী এবং বাবা মা সহ সংসারের সব মায়া মমতা ত্যাগ করে যে পাকিস্তান ছিনিয়ে এনেছিলেন সেই পাকিস্তান স্বাধীনের মাত্র বছর খানেকের মধ্যেই তাঁর মোহভঙ্গ হয়। তিনি বুঝে উঠতে সক্ষম হলেন এই স্বাধীনতা ঝুটা হ্যায়। যে পাকিস্তানের জন্যে জীবনপন বাজী রেখে লড়াই করেছিলেন সেই পাকিস্তান বাংলার মানুষের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন আনতে পারবে না একথাটি বুঝেছিলেন।  পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যহতি পরেই তা প্রকাশ হয়ে পরে, বুঝা যায় পাকিস্তান এক ষড়যন্ত্রের আখড়া। পাকিস্তান যে বাংলার মানুষের জন্যে আসে নাই সেটাই প্রকাশ পায়। পাকিস্তানের সিন্ধু, পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের জনসংখ্যার চেয়ে এক পূর্ব বাংলার লোক সংখ্যা বেশী হওয়ায় প্রথম থেকেই বাংলাকে দাবিয়ে রাখার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিলো।

বাংলার একেবারে মাটি থেকে উঠে আসা নেতা শেখ মুজিব বুঝেছিলেন প্রথম থেকেই। তাই তার রাজনৈতিক গুরু মউলানা ভাষানীকে সাথে নিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনে তিনি দেরী করেন নাই। এ থেকেই পরিস্কার বুঝা যায় মাটির কাছ থেকে উঠে আসা নেতা বঙ্গবন্ধুর সাথে অন্যান্য সামন্তাত্রিক জননেতাদের পার্থক্য। একারণেই অনেক বড়ো বড়ো নেতা বিদ্যমান থাকা সত্বেও বাংলার হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী হয়ে উঠেন শেখ মুজিব। তার জীবনের যৌবনে যে পাকিস্তান সৃষ্টির জন্যে ত্যাগ করছিলেন সকল মোহ, ভোগ আর বিলাসী জীবন সেই পাকিস্তানের স্বাধীনতার পরে ২৩ বছরের মধ্যে প্রায় ১৭ বছর জেলের মধ্যেই কাটিয়েছেন। এই ইতিহাস আমাদের সবার জানা। একনাগারে অনশন করে জীবনকে সংকটাপন্ন করে তুলেও তিনি অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেন নাই। বাঙ্গালীর মুক্তির সনদ ঘোষনা করে বাঙ্গালীকে পথ দেখিয়েছেন স্বাধীকার আর স্বাধীনতার। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাঁর পক্ষেই সম্ভব হয়েছে মনোবল টিকিয়ে রেখে স্বাধীনতার কথাটি উচ্চারন করতে। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি নির্ভীক ভাবে বলেছেন। আমি বাঙ্গালী। বাংলা আমার ভাষা, বাংলাদেশ আমার দেশ।

আমরা বড়ই অভাগা জাতি, এইরকম একজন আপাদমস্তক বাঙালি জননেতা পেয়েও তাকে হারিয়েছি অকালে। বাংলার মানুষের স্বভাব, সংস্কৃতি, আচার আচরন, মায়া মমতা, বিচার বুদ্ধি, দোষ গুন সবকিছুকেই আয়ত্ত করে বাংলার জলবায়ুতে বড়ো হয়ে উঠা বঙ্গবন্ধু এদেশের মানুষের হৃদয়ের মনিকোঠায় নিজেকে স্থান করে নিয়েছিলেন নিজের ব্যক্তিত্ব, নিজের বিচার বুদ্ধি দিয়ে। আজকের এই বাংলাদেশে তাঁর মতো নেতার আবার বড়ো প্রয়োজন। সেই অশিক্ষা, কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনা নিয়ে তিনি তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশকে ধাপে ধাপে তৈরী করেছিলেন সেই বাংলাদেশ আজ স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরে এসে পিছনে হাটছে। সাম্প্রদায়িক বিষবাস্পে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকেই আজ একশ্রেনীর রাজনীতিবিদ প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো এই যে, বঙ্গবন্ধু জীবিত কালে এদের প্রত্যেককে কোন না কোনভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে বাচিয়ে দিয়েছেন বা নিজেদের সংসারে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। সেদিনের সেই মহানুভবতা যদি তারা কাছ থেকে না পেতেন তাহলে অনেকেরই অনেক কিছুই হয়ে উঠা হতো না।

"আজ ১৭ই মার্চ মহামানবের এই জন্মদিনে সেই গানটির কথাই মনে পড়ছে

যদি রাত পোহালে শোনা যেতো বঙ্গবন্ধু মরে নাই। তবে বিশ্ব পেতো এক মহান নেতা,

আমরা পেতাম ফিরে জাতির  পিতা।"