মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা

কাজী রাশেদ
Published : 13 April 2015, 06:05 PM
Updated : 13 April 2015, 06:05 PM

সংক্রান্তি আর বরণ এই দুটোই বাঙালির জীবনের প্রতিটি ক্ষণের সাথে প্রতিটি মাসের সাথে মিশে আছে। আজকের এক দৈনিক পত্রিকায় লেখক পাভেল পার্থ খুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছেন বাঙ্গালির মাস বরন আর বিদায়ের কথকতা। যেহেতু বাংলা সনের চৈত্র মাস বছরের শেষ মাস তাই চৈত্র সংক্রান্তি বেশ ঘটা করেই পালন করে এসেছে গ্রাম বাংলার সকল জনপদ। সেই সাথে বৈশাখ বছরের প্রথম মাস হওয়াতে বর্ষবরণ হিসাবেই পহেলা বৈশাখকে সব জনপদেই খুব উৎসাহের সাথে বরন করে নিয়ে বছর শুরু করতে চেয়েছে। বাংলার ছয় ঋতু  প্রকৃতিতে যে পরিবর্তনের ছোঁয়া নিয়ে আসে এবং সেই সাথে আমাদের কৃষি নির্ভর গ্রামীন জনপদের যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিদ্যমান তাতে করে স্বাভাবিকভাবেই মাস শুরুর আড়ম্বর একটা থেকেই যায়। প্রকৃতির এতো ভিন্নতা পৃথিবীর অন্যকোন প্রান্তে দেখা যায় না বলেই বাংলাদেশের মানুষ তাদের জীবন জীবিকায় মাস শুরু এবং শেষের একটা আনুষ্ঠানিকতার বাতাবরন নিয়ে আসে প্রকৃতিগতভাবেই।

আমরা আমাদের ঋতু বিশ্লেষনে দেখতে পাই শীতের শেষে যে বসন্ত কালের আগমন ঘটে তাতে প্রকৃতি প্রথম মাসে যেমন ফুলে ফুলে ভরে উঠে ঠিক তেমনিভাবে দ্বিতীয় মাসে এসে খরতাপে জীবনকে করে তোলে ওষ্ঠাগত। মানুষের জীবনে এই তাপ বিভিন্ন রোগশোকে বিপর্যস্ত জনজীবন চেয়ে থাকে বৈশাখের আগমন অপেক্ষায়। কাল বৈশাখী ঝড় মানুষের অনেক ক্ষতির কারণ হলেও জনজীবনের মাঝে স্বস্তির পরশ বুলিয়ে দিয়ে যায়। আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কাল বৈশাখের ঝড়ের প্রভাবকে সাদরে গ্রহন করার জন্যে উদগ্রীব হয়ে থাকি। কবিগুরুর ভাষায় –এসো,এসো,এসো হে বৈশাখ।তাপসনিশ্বাসবায়ে  মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,    বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক॥যাক পুরাতন স্মৃতি,  যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,    অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক॥    মুছে যাক গ্লানি,ঘুচে যাক জরা,    অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।

বৈশাখের ঝড়ে প্রতি বছর দেশের বহু জায়গায় ঘরবাড়ী, গাছপালা, আমের বা ফসলের ক্ষেতের অনেক ক্ষতি সাধিত হলেও বাঙ্গার মানুষ হাসিমুখে তা গ্রহন করে। নিজের ক্ষয়ক্ষতির দিকে না তাকিয়ে সার্বজনীন ভালোকে মুল্য দেয় অনেক বেশি।বাংলাদেশের বিভিন্ন জনপদের বিভিন্নভাবে চৈত্র সংক্রান্তি এবং বর্ষবরণ উদযাপন করে থাকে। এমনকি হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভাইদের মধ্যেও এলাকা ভেদে চৈত্র সংক্রান্তি এবং বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে তারতম্য দেখতে পাওয়া যায়। তবে আমাদের বাংলাদেশে সেই পাকিস্তানী আমল থেকেই পহেলা বৈশাখকে আমাদের জাতিয় জীবনের এক সার্বজনীন উৎসবে পরিনত করার চেষ্টা চলে আসছে। এবং সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতার পর বাংলা বর্ষবরণ আমাদের জাতীয় উৎসবে পরিনত হয়েছে সকলের অংশগ্রহনের মধ্য দিয়ে।

বাংলার মুসলমানদের ঈদ, হিন্দুদের পুজা পার্বণ, খ্রিস্টান দের বড়োদিন অথবা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে ঘিরে যে সম্প্রদায়গত উৎসাহ দেখা দেয় ঠিক একইরকম উতসাহ-উদ্দীপনায় বাঙ্গালী বাংলা নববর্ষকে বরন করে নিচ্ছে। এতে ধর্মের যে বিভক্তি তা সম্পূর্ণভাবে তিরোহিত থাকে। তবে ইদানীংকালে পহেলা বৈশাখে পান্তা ইলিশ খাওয়ার যে ধুম পরে তার ইতিবৃত্ত কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। আমাদের সমাজে গতবছরের ভাত নতুন বছরের  খাওয়ার এক ধরনের মজার চলন চালু ছিলো। গ্রাম শহরের অনেক ঘরেই এই মজার জিনিষটি খুব আগ্রহের সাথে গ্রহন করা হতো। কিন্তু ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা খাওয়ার যে ঐতিহ্যের কথা এখন বলা হচ্ছে এবং বিশেষ করে শহরাঞ্চলের মানুষদের মধ্যে এক অশুভ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে তাতে পহেলা বৈশাখের আমেজকেই নষ্ট করে দিচ্ছে। এবার ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে জানা গেছে একহালি ইলিশ (এক কেজি প্রতিটি) ৪৮ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। আমরা এই অশুভ প্রতিযোগিতা বন্ধ দেখতে চাই। বৈশাখ মাস ইলিশের মওসুম নয়। তাই ঘটা করে ইলিশ মাছের ভাজি দিয়ে পান্তা খাওয়ার যে রীতি সে শুধু বিকৃতি মনমানসকিতারই বহিঃপ্রকাশ। খাওয়ার মতো ইলিশ পাওয়া যায় খুবই কম। বাকী সব জাটকা। এই জাটকাই আষাঢ়ের সময় পূর্ণতা পাবে। তাই বৈশাখে ইলিশ খাওয়ার যে রীতি তাতে করে জাটকা নিধনের পথকেই আমরা প্রশস্ত করছি। বৈশাখের নির্মল যে আনন্দ সেই আনন্দে টাকার প্রতিযোগিতাকে টেনে এনে বাঙ্গালীর প্রাণের অনুষ্ঠানকে বিতর্কিত করে তুলছি। পহেলা বৈশাখ আমাদের জীবনে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুলের ভাষায় নতুন দিনের কেতন উড়ানোর দিন হয়ে আসুক। আমরা সবাই মিলে তার ভাষায় গেয়ে উঠতে চাই –

তোরা সব জয়ধ্বনি কর!

তোরা সব জয়ধ্বনি কর!

ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়

তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!

আস্‌ল এবার অনাগত প্রলয়–নেশায় নৃত্য–পাগল,

সিন্ধু–পারের সিংহ–দ্বারে ধমক হেনে ভাঙল আগল!

মৃত্যু–গহন অন্ধকুপে, মহাকালের চন্ড–রূপে ধূম্র–ধূপে

বজ্র–শিখার মশাল জ্বেলে আসছে ভয়ংকর!

ওরে ওই হাসছে ভয়ংকর!

অথবা কবিগুরু ভাষায় বলে উঠি –

ওই বুঝি কালবৈশাখী

সন্ধ্যা-আকাশ দেয় ঢাকি॥

ভয় কী রে তোর ভয় কারে, দ্বার খুলে দিস চার ধারে–

শোন্ দেখি ঘোর হুঙ্কারে নাম তোরই ওই যায় ডাকি॥

তোর সুরে আর তোর গানে

দিস সাড়া তুই ওর পানে।

যা নড়ে তায় দিক নেড়ে, যা যাবে তা যাক ছেড়ে,

যা ভাঙা তাই ভাঙবে রে– যা রবে তাই থাক বাকি॥