মে দিবস বাংলাদেশে আরো বেশি প্রাসঙ্গিক

কাজী রাশেদ
Published : 28 April 2015, 03:46 PM
Updated : 28 April 2015, 03:46 PM

লোকাল বাসে যাওয়ার পথে এক সাধারন মহিলা খুব হঠাৎ করেই এক মন্তব্য করে আমাকে চমকে দিয়েছিলেন। আজ প্রায় দেড়মাসাধিকাল পরে যখন ১লা মে আসছে তখন উনার কথাই মনে পরে গেলো খুব। তখন সময়টা ছিলো বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ডাকা অনির্দিষ্ট কালের হরতাল অবরোধের। প্রতিদিনই মানুষ মরছে পেট্রোল বোমার আঘাতে, বাস পুড়ছে, ট্রেন পুড়ছে আর পুড়ছে সাধারন মানুষের কপাল। চলছে গনতন্ত্র উদ্ধারের নামে সারাদেশে মানুষ পুড়ানোর মহোৎসব। সেই সময়ে সেই সাধারন মহিলার প্রশ্ন ছিলো, আমরা মে দিবস পালন করি, সারা বিশ্বের মানুষ আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে পুলিশের গুলিতে নিহত মাত্র নয়/দশ জন মানুষের প্রাণত্যাগের ঘটনা স্মরন করে প্রায় দেড়শতাধিক বছর পার করে এসেও। তিনি বললেন, অবশ্যই তাদের আত্মত্যাগ কোন অংশেই কম ছিলো না, কিন্তু আজ যখন প্রতিদিন গনতন্ত্র উদ্ধারের নামে মানুষকে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে তখন কেউ তাদের স্মরনে কোন দিবস পালনের কথাও ভাবছে না। কেউ বলছে না এইসব শতাধিক মানুষ শহীদ হয়েছে। সবাই একে অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে নিজেদের দায়িত্ব এড়াতে চাচ্ছেন।

আজ মহান মে দিবসের প্রাক্কালে এসে সেই সাধারন মাকে লাল সালাম। লাল সালাম তাঁর ভাবনা কে। আজ থেকে দেড়শতাধিক বছর আগে কাজের সময় নির্ধারণের দাবিতে যে শ্রমিক ভাইয়েরা আন্দোলনে নেমেছিলেন তাদের আত্মত্যাগেই বিশ্বের সকল শ্রমিক শ্রেণী দৈনিক আট ঘন্টা সাধারন কাজের সুযোগ পাচ্ছেন। সেই হিসেবে সারা বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষ আজোও তাদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে অবনত চিত্তে। সেদিন শ্রমিক শ্রেনির কাজের  কোন সময় নির্ধারিত ছিল না। শিল্প কারখানা, মাঠে খামারে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পশুর মতো সীমাহীন পরিশ্রম করেও ন্যায্য মজুরী ছিলো অপর্যাপ্ত।

সময় পার হয়ে এসেছে অনেকটা পথ। শিল্প কারখানার প্রসার ঘটেছে জ্যামিতিক হারে। কিন্তু উৎপাদনের প্রধান উপাদানগুলোর অন্যতম শ্রম এবং সেই শ্রমের মালিক শ্রমিকশ্রেনির অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে গানিতিক হারের চেয়েও অনেক কম। বরঞ্চ জীবন ধারনের ব্যয় এতোই ঊর্ধ্বমুখী যে শ্রমিকের বেঁচে থাকাই হয়ে পড়েছে এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। এর সাথে আছে প্রতিনিয়ত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফলে শিল্পের আধুনিকায়নে শ্রমিকের কাজ করার সুযোগ কমে যাওয়া। একদিকে জীবন ধারনের মতো ন্যায্য মজুরীর অভাব অন্যদিকে কাজ হারানোর প্রতিনিয়ত হুমকি। এভাবেই আমাদের বিশ্বে প্রতিবছর আসে মে দিবস। অনেক সেমিনার, আলোচনা, অনুষ্ঠানাদির মধ্য দিয়ে পালিত হয় শ্রমিক দিবস। অনেক প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরিতে একদিনের জন্যে শ্রমিকেদের পাশে এসে দাঁড়ান সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষ, রাজনীতিবিদ আর সমাজসেবকরা। পরিবর্তন আসে না শিল্পের অভ্যন্তরে কাজের পরিবেশের, পরিবর্তন আসে না শ্রমিকের জীবন ধারনের জন্য নূন্যতম মুজুরী নির্ধারণে। অন্যদিকে শ্রমিকের স্বার্থের কথা বলে এমন পরিবেশ তৈরি করে একশ্রেনির শ্রমিক নেতৃবৃন্দ যাতে করে শ্রমিকের উপকার দূরের কথা বিদেশের বাজার পর্যন্ত হাতছাড়া হতে শুরু করে।

বিশ্বের অনেক দেশেই আজ শ্রমিকদের নূন্যতম মুজুরীসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রায় নিশ্চিত হয়েছে বা হওয়ার পথে। কিন্তু বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই আজো শ্রমিকদের নুন্যতম বেঁচে থাকার জন্য যে নুন্যতম মজুরি প্রয়োজন সেটাই এখনো অনেক দুরের ব্যাপার হয়ে রয়েছে। আজো অধিকাংশ শ্রমিকের নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থায় দিনাতিপাত করতে হয়। তাই মে দিবস অনেক দেশে আজ উৎসবের দিন হলেও বাংলাদেশে দাবি আদায়ের শপথের দিন হিসাবেই পালিত হয়ে আসছে। মে দিবসের প্রাসঙ্গিকতা আজো শেষ হয়ে যায় নাই বাংলাদেশের শ্রমিকশ্রেণির জন্যে।

বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শিল্পকারখানায় দুর্ঘটনায় বা আগুন লেগে বহু মানুষের তথা শ্রমিকের দুঃখজনক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এমন কি দুয়েকটি ঘটনা সারা বিশ্বে নাড়া দিয়েছে। আমাদের অন্যতম পোষাক আমদানীকারক দেশ আমেরিকা এইসব ঘটনায় জিএসপি সুবিধা পর্যন্ত স্থগিত করেছে। যদিও একই সঙ্গে বিশ্বের প্রায় অর্ধশতাধিক দেশের জন্যেই এই স্থগিতাদেশ দিয়েছে বিশ্বের অন্যতম এই প্রধান আমদানীকারক দেশ যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের উপরে এই জিএসপি স্থগিতাদেশে কিন্তু পরোক্ষভাবে হলেও কিছু শ্রমিক সংঘঠন এবং অতি উৎসাহী সংবাদ মাধ্যমকে দায়ি  করা যায়।

এবারের মে দিবসের প্রাক্কালে আমাদের অবশ্যই স্মরন রাখতে হবে আমাদের দেশ এখন অনেক বেশি শিল্প বিকাশের পথে ধাবমান। চীনের মজুরি বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে এবং শিল্পনীতির কারণে অনেক দেশ চীন থেকে তাদের শিল্প সরিয়ে নেওয়ার চিন্তায় আছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেকটাই পছন্দের তালিকায় এগিয়ে। প্রতিযোগিতা আছে ভিয়েতনাম, ভারত এবং ফিলিপাইনের সঙ্গে। সেই কথা মাথা রেখে আমাদের শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষা এবং কাজের পরিবেশকে আরো উন্নত করতে হবে। শ্রমিক সংঘঠনগুলোকে আরো বেশি করে দেশের স্বার্থ বজায় রেখে নেতৃত্ব দিতে হবে। যে কোন আন্দোলন বা দুর্ঘটনার খবর আরো যত্নশীল হয়ে পরিবেশনে মনোযোগি হতে হবে। বিদেশী উদোক্তাদের নিশ্চিত করতে হবে তাদের শিল্পকারখানার নিরাপত্তার ব্যাপারে। পাশাপাশি আমাদের দেশের শ্রমিকশ্রেনি যেন এইসব বিদেশী উদ্যোক্তাদের কাছে শোষিত না হয় সে ব্যাপারেও কৌশলী হতে হবে এখন থেকেই।

মে দিবস আমাদের দেশের শ্রমিকের স্বার্থরক্ষায় সবসময় অনুপ্রেরণার দিন হয়ে থাকুক এই প্রত্যাশা সকল শ্রেনীর মানুষের।