গনতন্ত্রে নির্বাচন অন্যতম শর্ত কিন্তু একমাত্র নয়

কাজী রাশেদ
Published : 23 May 2015, 06:05 AM
Updated : 23 May 2015, 06:05 AM

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে বিএনপির এককালীন নেতা এবং প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যদের অন্যতম ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা অনেক ঘটনা জন্ম দিয়ে গত কয়েকদিন আগে এক সংবাদ সন্মেলনের মাধ্যমে নতুন এক এজেন্ডা ঘোষনা করেছেন।  অতীতে অনেক বিতর্কিত কথা বলে ব্যারিস্টার সাহেব নিজ দলে এবং রাজনীতিতে অনেক তোলপাড় তুলেছিলেন। নিজ দল থেকে দূরে সরে গেছেন বারবার। ম্যাডামের অনেক প্রিয়ভাজন হয়েও গত মাসখানেক আগে ম্যাডামের সাথে পূর্ব আয়োজিত সাক্ষাতের কথা থাকলেও গুলশান কার্যালয়ের গেট থেকে ফিরে আসতে হয়েছিলো এইসব অগোছালো বা সত্য কথনের জন্যে। এবং তারপরেই আবার পুরোপুরি বিএনপির সাথে সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন করে ২৯ দলীয় জোট গঠন করে বিএনপি এবং বিশ দলীয় জোটের জ্বালাও পোড়াও আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। জোট হিসাবে ব্যারিস্টার সাহেবের এই জোট এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো রাজনৈতিক জোট হলেও জনবল কতটূকু আছে সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। যাহোক প্রায় সবকটি সাইনবোর্ড সর্বস্ব দল নিয়ে গঠিত ব্যারিস্টার সাহেবের এই জোট তাদের সংবাদ সন্মেলনে সুন্দর এক রূপরেখা ঘোষনা করেছেন। এই সংবাদ সন্মেলনে ব্যারিস্টার সাহেব একটি সুষ্ঠ ও অবাধ জাতীয় নির্বাচনের স্থায়ী রূপরেখা শীর্ষক একটি এজেন্ডা উপস্থাপন করেছেন। তিনি এই রূপরেখাকে জাতীয় সংলাপের একমাত্র এজেন্ডা হিসাবে তুলে ধরার প্রয়াস করেছেন।

বাংলাদেশে নির্বাচনী ব্যাবস্থা এবং এর সংস্কার একটি সমস্যা অবশ্যই। গনতন্ত্রের একটি অন্যতম সর্ত হতে পারে সন্দেহ নেই কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে নির্বাচনই একমাত্র সমস্যা এবং সংলাপের একমাত্র এজেন্ডা এমনটা ভাবার মনে হয় অবকাশ খুব কম। অবশ্য আমাদের সংবাদ মাধ্যম এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার টক সো গুলো শুনলে মনে হবে বাংলাদেশের সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। শুধুমাত্র একটি সুষ্ঠ ও অবাধ নির্বাচন হয়ে গেলেই জনগনের জীবনের সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

আমাদের দেশের দারিদ্রের হার এখনো শতকরা ৪০ ভাগের উপর। এখনো শিক্ষার হার শতকরা ৫০ ভাগের নীচে, বিদ্যুতের চাহিদা এখনো অপূরণীয় থেকে গেছে। জাতীয় আয় ১৩৪১ ডলারে উন্নীত হলেও এই হার গড়পরতা সেটা ভুলে গেলে চলবে না। সাগরের নিশ্চিত মৃত্যু কে জেনেও যে দেশের মানুষ প্রতিদিন জীবন ও জীবিকার সন্ধানে সাধারন নৌকায় পাড়ি জমাচ্ছে অজানা অচেনা ঠিকানায় সেই দেশে সংলাপের একমাত্র এজেন্ডা হবে নির্বাচন সেটা পাগলের প্রলাপ ছাড়া অন্য কিছু নয়। তবুও ব্যারিস্টার সাহেব জাতীয় নির্বাচনের জন্যে যে রূপরেখা দিয়েছেন তা বাস্তবায়ন করলে   আগামী নির্বাচন গ্রহনযোগ্যতা পাবে অনেকাংশে। এজন্য ব্যারিস্টার সাহেব অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। তিনি নির্বাচনের জন্য বর্তমান সাংবিধানিক আইনকেই গ্রহনযোগ্য বলেছেন। আবার তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার আশাও ছাড়েন নাই। এখানেই তার রূপরেখার গ্রহনযোগ্যতা অনেক বেশী।

রূপরেখার প্রথমেই তিনি ভোটার তালিকার হালনাগাদ করন প্রসঙ্গে বলেছেন।তিনি তার প্রস্তাবনায় মাত্র সাতদিনের মধ্যে ভোটার তালিকা স্বচ্ছভাবে নিশ্ছিদ্র ভাবে করা সম্ভব। ইউনিয়ন পরিষদের সব্বোচ্চ ৯টি করে ওয়ার্ড আছে। প্রতি ওয়ার্ডে ১৫০০ থেকে ২০০০ ভোটার রয়েছে। প্রতি ওয়ার্ডে একজন করে নির্বাচিত ইউপি সদস্য থাকেন। সেইসব ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের দিয়ে ভোটার তালিকা নির্ভুল ভাবে প্রনয়ন বা হালনাগাদ করা সম্ভব। এতে করে যেমন ভোটার তালিকায় ভুলের সংখ্যা কমে আসবে তেমনি যেকোন ভুলের জন্য সেই নির্বাচিত সদস্যকে দায়ী করা যাবে।

ভোটারদের পরিচয় পত্রের যায়গায় পাসপোর্ট ব্যবহারে প্রস্তাব করেছেন। এই পাসপোর্টে তিনি ভিসা এবং ভোটের জন্য পাতা রাখার বিধান করতে বলেছেন।

নির্বাচনী ব্যয় সংকোচনের জন্য ক্যাম্প প্রথা সংকোচনের কথা বলেছেন। নির্বাচনী প্রচারনার জন্য মাত্র দশদিনের ব্যবস্থা করতে সুপারিশ করেছেন।

সার্বক্ষণিক নির্বাচনী পর্যবেক্ষণের কথা উল্লেখ করেছেন।

নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের কথা বলেছেন। এ ব্যাপারে অবশ্যই নির্বাচন কমিশনের জন্য পর্যাপ্ত নিজস্ব লোকবলের কথা বলেছেন। নির্বাচনের সময় সরকারের অন্যান্য মন্ত্রনালয় থেকে বা প্রশাসন থেকে জনবল নিয়ে নির্বাচন পরিচালনা নির্বাচনে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন সম্ভব হয়ে উঠে না।

এছাড়াও রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল প্রসঙ্গেও তিনি বিভিন্ন প্রস্তাবনা তুলে ধরেছেন। যেগুলোকে আসলেই অস্বীকার করার পথ নেই। ব্যারিস্টার সাহেবের রাজনৈতিক জোটের জনবল থাকুক আর নাই থাকুক এই প্রথমবারের মতো একটি বাস্তবসম্মত প্রস্তাবনা উত্থাপন করেছেন। এজন্যে ব্যারিস্টার সাহেব ধনবাদ পাওয়ার যোগ্য।

তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা হোক বা পৃথিবীর বাহিরে থেকে লোক নিয়ে এসে হোক নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন না আসলে একটি সুষ্ঠ এবং অবাধ নির্বাচন আসা করা বাতুলতার নামান্তর। গত ৯১ সাল হতে ২০০৮ পর্যন্ত তথাকথিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও কোন দলই এই নির্বাচন গুলোকে সুষ্ঠ ও অবাধ হিসাবে মেনে নিতে পারে নাই।

একটি গনতান্ত্রিক সমাজে নির্বাচন অবশ্যই একটি অন্যতম শর্ত কিন্তু কখনোই একমাত্র শর্ত হতে পারে না। আমাদের দেশের বহুবিধ সমস্যা বিদ্যমান। সেইসব সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে তার সমাধানের পথ আমাদেরকেই বের করতে হবে। শুধুমাত্র টিভি পর্দার টকশো গুলোতে বড়ো বড়ো কথা বলে নিজের পান্ডিত্য জাহির করা সহজ পথ। জনগনের সমস্যা চিহ্নিত করে সেই সমস্যার সমাধান জনগনের কাতারে থেকেই করতে হবে। এই বাস্তবতা মেনে নিয়ে জনগনের কথা ভাবুন, জনগণকে নিয়ে কাজ করুন। তখন টিভি পর্দায় না আসলেও জনগনের মনি কোঠায় থেকে যাবেন অনন্তকাল।