জালালের গল্প এবং বিচারহীন বাংলাদেশ

কাজী রাশেদ
Published : 6 Sept 2015, 06:52 PM
Updated : 6 Sept 2015, 06:52 PM

ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ব্যানারে আবু শাহেদ এর কাহিনী, চিত্রনাট্য এবং নির্দেশনায় জালালের গল্প নামে একটি চলচ্চিত্র ঢাকাসহ কয়েকটি সিনেমা হলে সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে। ইম্প্রেস টেলিফিল্মের ব্যানারে নির্মিত সিনেমাগুলির নির্মাণ শৈলী এবং কাহিনী ও তারকা নির্বাচনে অনেক যত্নের ছাপ থাকে বলে দর্শক প্রয়তা পেতে বেশী ভোগান্তি পেতে হয়না। সেক্ষেত্রে এই পর্যন্ত বেশ কিছু ছবি দেশে এবং আন্তর্জাতিক ভাবে পুরস্কৃতও হয়েছে।

জালালের গল্প বাংলাদেশে মুক্তি পাওয়ার আগেই বেশ কিছু আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছে। আমরা সবাই জানি বাংলাদেশের সবকিছুতেই আন্তর্জাতিক পুরস্কার বা অনুমোদন পেলে সাধারন মানুষ অনেকবেশি মুল্যায়িত করে। সেক্ষেত্রে জালালের গল্পও তার ব্যতিক্রম নয়। উপরুন্ত যেহেতু ইম্প্রেস টেলিফিল্মের ছবি তাই তার মুক্তির আগে বিদেশী পুরস্কারের তকমা লাগানোটা আরো বেশি যৌক্তিক বলে মনে করেন ইম্প্রেস টেলিফিল্মের কর্তৃপক্ষ।

নদীতে ভেসে আসা এক নবজাতককে কেন্দ্র করে এই ছবির গল্প এগিয়ে চলে। ভেসে আসা শিশুটিকে পাওয়ার পর থেকে গ্রামের নদীর ঘাটে প্রচুর মাছ পাওয়াকে গ্রামবাসী বাচ্চাটির সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করে। বাচ্চাটিকে যে প্রথম দেখে তাকেই দেওয়া হয়েছিলো বাচ্চাটির ভোরনপোষনের ভার। ফলাফলে বাচ্চাটিকে নিয়ে শুরু হয় ব্যবসা। পানিপড়া আর নানারকম কুসংস্কারের মাধ্যমে রোজগার পাতির ধান্ধা শুরু হয়। ফলে গ্রামের মানুষের মধ্যে দ্বন্ধেরও শুরু এখানে। ইম্প্রেস টেলিফিল্ম এই কুসংস্কার আর ধান্ধাবাজীর বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদে দেখাতে পারে নি তাদের চলচ্চিত্রে। বরঞ্চ এই কুসংস্কারের দ্বারা যে লাভের ব্যবসা সেই ব্যবসায় ভাগ না পাওয়ার আক্ষেপ দেখিয়ে প্রকারান্তে এই ব্যবসার প্রতি সমর্থন যুগিয়েছে।

এবং দুই লোভের দ্বন্ধে একটি নিস্পাপ শিশুর আবারো জলে ভেসে যাওয়ার পরিনিতি দেখিয়ে এদেশের মানুষের বিবেকবোধকে প্রকারান্তে বিদ্রুপ করেছেন। এবং খুব সুক্ষভাবে হলেও বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার ব্যর্থতা কে প্রমাণ করে দেখাতে চেয়েছেন।

এ গেলো প্রথম পর্বের কাহিনী। বিরতির পরে সেই শিশু এক স্বৈরাচারী গ্রাম্য ক্ষমতাশালীর আশ্রয়ে দিনাতিপাত করে এবং এক ভন্ড সন্যাসীর কোপানলে পরে বস্তাবন্দী হয়ে জীবন-মরনের সঙ্কটে পতিত হয়। এখানে গ্রামের মাতব্বর এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত সন্যাসী ফকিরদের ভন্ডামী সত্যিকার ভাবে তুলে ধরলেও এ থেকে মুক্তির বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোন প্রতিকার দেখানো হয়নাই। বরঞ্চ একটি শিশু এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গেলেও তাকেই প্রান সংশয়ের মধ্যে পতিত হয়ে হয়। শিশুটিকে জীবন্ত অবস্থায় বস্তায় পুরে নদীতে কলাগাছের ভেলায় ভাসানোর মধ্য দিয়ে ইম্প্রেস টেলিফিল্ম শিশু নির্যাতনের আরো এক নতুন কউশল শিখিয়ে দিলো। এখানেও ইমপ্রেস টেলিফিল্ম গ্রাম্য মাতব্বরদের এইসব কর্মকাণ্ডকে উৎসাহ যুগিয়েছে।

এতে করে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের আরো কিছু পুরাতন কায়দা নতুন করে উপস্থাপন করেছেন। যাতে করে সমাজে আরো কিছু রাকিব, রাজন আর রবিউলদের প্রাণ দিতে হয় সন্ত্রাসীদের হাতে নতুন কায়দায়। মানুষকে মেরে ইটের ভাটার আগুনে পুরিয়ে মারার কৌশল ইমপ্রেস টেলিফিল্ম কাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করলেন তা পরিস্কার হয়ে গেছে। আমাদের দেশে রাজন বা রবিউলদের মৃত্যুতে নতুন নতুন কায়দা প্রয়োগ এইসব ইমপ্রেস টেলিফিল্মের মাধ্যমেই সন্ত্রাসীরা পেয়ে থাকেন। নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো বাস্তব ভাবে ফুটিয়ে তোলা হলেও প্রতিকার বা প্রতিরোধের কোন গল্প এই সিনেমায় নেই।

জালালের গল্পে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনেক অন্যায় অত্যাচারের কথা দেখানো হলেও কোথাও এইসব অনাচার অত্যাচারের বিরুদ্ধে কোন প্রতিরোধ বা প্রতিবাদের চিহ্ন খুজে পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের সিনেমাগুলোয় সবসময় অন্যায় অত্যাচারের অবসান দেখানোটা একটা রেওয়াজ। কিন্তু ইমপ্রেস টেলিফিল্ম সেই রেওয়াজ থেকে বেরিয়ে এসে কাকে কটাক্ষ করতে চাচ্ছে এবং কাদের সহযোগিতা করতে চাচ্ছেন সেটা আজ পরিস্কার হওয়া জরুরি।

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থায় একশ্রেণীর সুশীল, সংবাদ মাধ্যম এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এইদেশকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিনত করার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এরা মুখে মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং প্রগ্রতিশীল রাজনীতির পক্ষে কথা বললেও বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এই দেশকে একটি বিচারহীন রাষ্ট্র হিসাবে তুলে ধরার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। জালালের গল্প এই দেশটাকে বিচারহীন করার প্রক্রিয়ারই একটি অংশ। এতো অন্যায় অনাচার আর অত্যাচারের ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও কোন বিচারের বা প্রতিকারের ব্যবস্থা পুরো ছবির কোথাও নেই।

জালালের গল্প আমাদের দেশেরই গল্প। প্রতিনিয়ত জালাল্রা কখনো নদীতে ভেসে অথবা রাস্তায় ঘুরতে ঘরতেই কোন এক ঠিকানায় ঠাঁই পায় আবার সেখান থেকে উচ্ছেদও হয়। রাজন, রাকিব বা রবিউলরা সমাজের বিভিন্ন স্তরে নির্যাতিত হয়, প্রাণ হারায় একথা যেমন সত্য তেমনিভাবে এইসব হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে সাধারন মানুষ প্রতিবাদেও  ফেটে পড়ে। আইনের আওতাতেও নিয়ে আসা হয় সন্ত্রাসীদের। জনগনের সেই বিবেকের কথা জালালের গল্পে কোথাও উঠে আসে নাই। এবং এই উঠে না আসাটা অনেকটাই ইচ্ছাকৃত ভাবে নয় কি?