নিজেদের চুল ছেঁড়া ছাড়া উপায় থাকবে না

কাজী রাশেদ
Published : 23 April 2016, 05:11 AM
Updated : 23 April 2016, 05:11 AM

সামাজিক মাধ্যম গুলোতে আজকাল ভীষণভাবে একশ্রেণির মানুষের মধ্যে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। অস্থির উঠছে দেশের সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে, চিন্তিত হয়ে উঠছে প্রতিদিনের খুন ধর্ষণ আর হানাহানির খবরে। পত্রিকার পাতাগুলো ভরে থাকছে খুন, ধর্ষণ, চুরি ডাকাতি, রাহাজানি আর মানুষে মানুষের সংঘর্ষের খবরে। আগে মানুষ এইসব খবর পড়তো এবং নিজেদের মধ্যেই আলাপ আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের মতামত আর উদ্বিগ্নতা ভাগাভাগি করে নিতো। বর্তমানে ইন্টারনেটের সুফলে এবং সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার সহ বিভিন্ন ভাবে নিজেদের চিন্তা ভাবনা গুলোকে সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে দিতে পারছে। ফলে সমাজে বা দেশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো কে ধামাচাপা দেওয়ার কোন উপায় থাকছে না।

২০০১ সালে বিএনপি-জামাত জোট যখন নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এলো, সেইসময়ের অব্যাহতির পরে সারাদেশ জুড়ে বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের উপর যে বিভীষিকাময় অত্যাচার চালিয়েছিলো জোটের কর্মীবাহিনী তার দগদগে ঘায়ের ক্ষত এখনো শুকিয়ে যায় নি। সেদিন বাগেরহাটের হিন্দু পরিবারের তেরো বছরের এক সদ্য কিশোরী কে সাতজন নরপশু ধর্ষণ করতে এসেছিলো তার মা নিরুপায় হয়ে বলেছিলো বাবারা আমার মেয়েটা ছোট, তোমরা একজন একজন করে আসো। সেই নরপশুদের কি হয়েছে জাতি তা জানে না। কিন্তু সেই পরিবার আর বাংলাদেশে থাকে নাই। সারা দেশের সেই ভয়াবহ তান্ডব নিয়ে দেশের বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে প্রায় সকল স্তরের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পরেছিলো। আজ কিন্তু সেই দিন গুলো আবার ফিরে আসছে। সবার মাঝে এক তীব্র ভয় ভীতি কাজ করছে। জেলায় জেলায় হিন্দু জনগোষ্ঠীর এক বিশাল অংশ নিরাপত্তার অভাবে দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা করছে।

বিভিন্ন সভা সেমিনার করে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর নজর কাঁড়ার ব্যবস্থাও তৎকালীন বিরোধী দল নিয়েছিলো। এই বীভৎসতার বিরুদ্ধে জনগনের ক্ষোভ ফেটে পরেছিলো বলেই বিএনপি-জামাত জোট হাজার চেষ্টা করেও ক্ষমতায় একদিনের বেশী টিকে থাকতে পারে নাই।

আজ ২০১৬ সাল। ২০০১ এর সেই বীভৎসতা কাটিয়ে উঠে দেশ এবং জাতি আজ অনেকটাই এগিয়ে গেছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে বর্তমান সরকার দেশকে সঠিক পথে নিয়ে যাওয়ার যে পরিকল্পনা এবং রূপরেখা দিয়েছিল তা অনেক ক্ষেত্রেই সফলতার মুখ দেখছে। পরিসংখ্যানগত ভাবে হলেও বাংলাদেশ আজ মধ্যম নিন্ম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের মুখ ঘুরিয়ে নেয়া প্রকল্প পদ্মা সেতু আজ নিজেদের অর্থায়নে বাস্তবে পরিণত হতে চলেছে।

অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির হার প্রতি বছরেই ঊর্ধ্বগতি। এমতাবস্থায় দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিত আজ সবচেয়ে নাজুক অবস্থায়। খুন, ধর্ষণ আর চুরির রমরমা খবরে পত্র পত্রিকার পাতা ভরে থাকছে দীর্ঘদিন ধরে। চলন্ত বাস থেকে শুরু করে নিরাপদ সেনানিবাসের মধ্যেও একে একে ধর্ষণ খুন হয়েই চলেছে। কিছু ধরা পরে, কিছু ধরা পরে না। প্রভাবশালীদের চাপে সেইসব ধর্ষণ মামলার প্রায় সবই ধামাচাপা পরে যাচ্ছে। বিচারের বানী শুধু নিরবেই গুমরে কাঁদছে।

প্রতিটি ঘটনা ঘটছে অথচ কোন ঘটনারই রহস্যের কুল কিনারা করতে পারছে না পুলিশ বাহিনী। গত দুই তিন বছরে একে একে খুন হয়েছে মুক্তমনা নামে দশজন ব্লগার। এক রাজীব হত্যার মামলার ফয়সালা ছাড়া আর কোনটারই রহস্য উন্মোচন করা যায় নাই। একে একে খুন হয়েছে কয়েকজন বিদেশী। প্রায় একই কায়দায় খুন গুলো সংঘঠিত হলেও খুব বেশী রহস্যের জাল ছেঁড়া সম্ভব হয় নাই। খুন হয়েছে বিভিন্ন ধর্মীয় নেতা। এই সিরিজে মাওলানা থেকে শুরু করে পীর, পাদ্রী, পুরোহিত এবং বৌদ্ধ ভিক্ষু। সবই একই কায়দায় খুন করা হয়েছে এই ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সবাই এইসব হত্যাকাণ্ডের ভিতরের রহস্য উদ্ঘাটনের ব্যাপারে আশ্বাস দিলেও জনগন অন্ধকারেই রয়ে গেছে। এমন কি সাংবাদিক সাগর-রুনির হত্যাকান্ডের কোন রহস্যই উন্মোচিত করা সম্ভব হয় নাই।

সামাজিক গনমাধ্যম ফেসবুকে বিভিন্ন মানুষের আহাজারি আজ দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করে তুলছে। শোনা যাচ্ছে নিরাপত্তার অজুহাতে সেই ২০০১ সালের মতো হাজার হাজার সংখ্যালঘু দেশত্যাগ করে পাশের দেশে আশ্রয় গ্রহণ করছে। এই যদি সত্যি দেশের অবস্থা হয় তাহলে সাধারণ জনগন আর কোন দলের উপর তাদের আস্থা রাখবে? দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করার চক্রান্ত অনেক আগে থেকেই করা হচ্ছে। যদিও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং ফাঁসি তাদের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে। এদেশের মানুষের কাছে তাদের ধর্মের যে লেবাস ছিলো তা খসে পরেছে। সেইদিক থেকে তারা টিকে থাকার জন্য বা আবার উঠে দাড়ানোর জন্যে মরণ কামড় দিবেই। আজকের অস্থিরতা, প্রতিদিনের খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি আর সংখ্যালঘু নির্যাতন তাদের রাজনীতিতে ফিরে আসার হীন ষড়যন্ত্রের অংশ হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। যে শক্তি প্রকাশ্যে আগুন বোমা মেরে বা বাসে আগুন ধরিয়ে দিয়ে মানুষ হত্যা করতে পারে তাদের দ্বারা অসম্ভব কিছুই নাই।

স্বাধীনতার অব্যাহতি পরেই সামরিক শাসকদের ক্ষমতা দখল এদেশের রাজনীতি গনতান্ত্রিক পরিবেশে লালিত পালিত হওয়ার সুযোগ পায় নাই। বাম সংঘঠন গুলো নিজেদের তথাকথিত মতভিন্নতার কারণে নিজেদের শতধা বিভক্তিতে শক্তি ক্ষয় করেছে। আজো তা অব্যাহত আছে। বিএনপি-জামাতের সাথে ক্ষমতার লোভে এমনভাবে গাঁটছড়া বেধেছে তা থেকে অদুর ভবিষতে বের হয়ে আসার সম্ভাবনা খুবই কম। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাজনীতিতে মন্দের ভালো বলতেই হয়। ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা তারা অত্যন্ত মুখে বলে। সেই ভরসাতেই এদেশের অসাম্প্রদায়িক জনগন আওয়ামী লীগ থেকে এখনো মুখ ঘুরিয়ে নেয় নাই।

কিন্তু সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠির উপর নির্যাতন নিপীড়ন না থামাতে পারলে, খুন ধর্ষণ এর উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত না করতে পারলে মানুষ মুখ ঘুড়িয়ে নিতে দেরী করবে না। যদি সত্যি পরাজিত শক্তির পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ মদদে এইসব অরাজকতা হয়ে থাকে তাহলেও সরকারকেই এর পরিত্রাণ খুঁজে বের করতে হবে। অপরাধী চক্র যতো শক্তিশালী হোক না কেনো সরকারের ক্ষমতার বাইরে নিশ্চয় নয়। আবার গৎবাঁধা পরাজিত শক্তির উপর দোষ চাপিয়ে পার পাবার সময়ও কিন্তু আর নেই। সময় চলে গেলে নিজেদের চুল ছেঁড়া ছাড়া অন্য কোন উপায় থাকবে না।

এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলা ভালো, আওয়ামী লীগ যখন জিতে তখন মনে করে সে একাই জিতেছে। আর যখন হারে তখন সবাইকে নিয়েই হারে। এই অবস্থা থেকে আওয়ামী লীগকেই বের হয়ে আসতে হবে।