শান্তির জনপদে অশান্তির আগুনে পুড়ছে মানবতা

কাজী রাশেদ
Published : 6 June 2017, 08:45 PM
Updated : 6 June 2017, 08:45 PM

পাহাড় আবার অশান্ত। পাহাড়ের আদি বাসিন্দা আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির সাথে খাপ খাইয়ে চলে আসা পাহাড়ের শান্তি প্রিয় আদিবাসী ভাই বোনেরা আবার জীবন-মরণ প্রশ্নের সম্মুক্ষীণ। ১৯৯৮ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাহাড়ে দীর্ঘ দুই যুগেরও অধিক কাল ধরে যে হানাহানি, হিংসা আর প্রাণনাশের হোলিখেলা চলেছিলো তা বন্ধ করতেই শান্তিচুক্তি করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পাহাড়ের একচ্ছত্র নেতা শন্তু লারমা। শান্তি কতটুকু এসেছে তা পর্যালোচনার ব্যাপার। এইসব পর্যালোচনা সংসদীয় আদিবাসী ককাশ আর ড. মেসবাহ কামালের বইয়ের মধ্যেই ভালো পাওয়া যাবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।

১৯৯৮ সালের পর থেকে আজ অবধি অনেক পানি কর্ণফুলি দিয়ে বয়ে গেছে। শান্তি চুক্তির কারণে ফেনী পর্যন্ত ভারতের হয়ে গেছে কিন্তু পাহাড়ি ভাইবোনদের ভাগ্য যে তিমিরে ছিলো সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। যারা শান্তি চুক্তিকে ভুয়া বলেছিলো তারাও ক্ষমতায় এসে শান্তিচুক্তি বাতিল করেনি। বরঞ্চ নতুন নতুন আইন করে পাহাড়ি বাঙালির মধ্যে বিরোধ উস্কে দিয়েছে।

গতকাল লংগদুতে এক বাঙালি ছেলের মৃতদেহ পাওয়াকে কেন্দ্র করে যে নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হলো তাতে মনে করার কোন কারণ নেই যে পাহাড়ে শান্তিচুক্তি বলে কোন চুক্তি বিদ্যমান। এক চাকমা তরুণীর সামাজিক মাধ্যমে যে বিভীষিকা ফুটে উঠেছে তা ৭১ এর কথা মনে করিয়ে দিয়েছে।

সেই বোনের আকুতিটা এখানে তুলে ধরছি। সেই সাথে চাকমা বোনটির কাধে হাত রেখে বলতে চাই আপনার এই বিভৎস স্মৃতিটুকু ভুলে যান। আমরা আছি আপনাদের পাশে। সঙ্গে লড়াইটা আবার শুরু করতে হবে এই প্রত্যয়ে বলিয়ান হোন।

"বিচারের কোন প্রত্যাশা নয়, যেগুলো লিখছি প্রাণে বেঁচে গেছি বলে আকুল আকুতি বিশ্ব মানবতার কাছে। হয়তো আর লেখাও হতোনা এভাবে। এতক্ষণে নিষ্প্রাণ দেহটা কোথায় পড়ে থাকতো। গতকাল সকালে নাশতা করতে বসেছিলাম আমরা চারজন। হঠাৎ ফোনে এক দিদির চিৎকার! দিদি আমাকে ফোন করে চিৎকার দিয়ে বলছে, এখন এই মূহুর্তে বাসা থেকে বের হয়ে একলাফে নিরাপদ জায়গায় সরে যাও! ফোন কানে রেখে পরিধেয় পোশাক সম্বল করে দৌঁড়ে বিপদজনক এক জায়গায় কোনরকম মাথাগুজে দিই! ততক্ষণে বাইরে চিৎকার আগুনের দাউদাউ শব্দ আমার হৃদপিন্ডে কাঁপন ধরিয়েছে! ওরা চাকমা খুঁজছে! চাকমা পেলে জবাই করবে! খবর আসলো ওদের কেউ কেউ বলছে, চাকমা থাকলে বের করে দেন জবাই করবো!

কিভাবে কোথায় ছিলাম সেকথা নিরাপত্তার স্বার্থে গোপন রাখছি। ফোনে কারোসাথে কথা বলার মত অবস্থা নেই। এসএমএস ছিলো বাড়িতে খবর দেয়ার একমাত্র উপায়। এখন নিরাপদ জায়গায় আছি, প্রাণে বেঁচে আছি। তাই লিখছি!

ঘটনাটা গতকাল জুন দুই তারিখ ২০১৭ শুক্রবার সকাল দশটার দিকের ঘটনা। রাংগামাটি পার্বত্য জেলার লংগদু উপজেলা। চাকরির পোস্টিং ওখানে আমার। বৃহস্পতিবার এক মটরসাইকেল চালক বাঙালির লাশ পাওয়া যায়। কোন প্রমাণ নেই কে বা কারা হত্যা করেছে। পরে অবশ্য ধীরে ধীরে খবর আসতে থাকে ঐ চালক দুইজন বাঙালি যাত্রী নিয়ে গিয়েছিলেন। ততক্ষণে ধ্বংসযজ্ঞ যা হবার হয়ে গিয়েছে। মুসলিমরা বলেছে আদিবাসীরা হত্যা করেছে। মূহুর্তেই আদিবাসীদের সমস্ত ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। একজন বৃদ্ধা মহিলাকে ইচ্ছেমত মারধর করে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে। সেই ঊনিশশো ঊননব্বইয়ে লংগদু উপজেলায় এমন নৃশংস ঘটনা ঘটেছিলো। গতকাল আবার সেই একই ঘটনা।

সবকিছু পুড়িয়ে যাবার পর প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করলো! বিস্ময়কর প্রশাসন সেনাবাহিনী হামলাকারী মুসলিমদের পিছনে ছিলো। যখন চাকমারা হামলা ঠেকাতে মুসলিমদের প্রতিরোধ করতে যায় তখন মুসলিমদের পিছনে লুকিয়ে থাকা সেনাবাহিনীরা ব্ল্যাংকফায়ার করে। চাকমারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

এভাবে আমরা শেষ হয়ে যাব। আমাদের অস্তিত্ব কেবল বইয়ের কোন একটা পাতায় হালকাভাবে লেখা থাকবে। এদেশ ভুলে যাবে এখানে আদিবাসী নাগরিক ছিলো। আমাদের প্রাণ গোপনে ঝরে যাবে। কেউ জানতেও পারবেনা আমরা কোরবানীর গরুর মত জবাই হয়েছি। দুঃখ লাগছে, আশ্চর্য্য হচ্ছি, প্রতিদিন যাদের সামনে পেলে বিনয়ের সাথে অন্তর দিয়ে সেবা করি তারা আমাদের ঠাসঠাস মেরে ফেলতে উদ্যত হয়! লংগদুতে এখন আদিবাসীর আর কোন ঘরবাড়ি নেই। পরিধেয় বস্ত্রে এক পোশাকে ওরা এখন জীবনের আশংকায় পালিয়ে ঘুরছে। কত আহাজারি প্রাণের আকুলতা হাহাকার করছে। প্রমাণহীন এক হত্যা, আর সেটা হয়তো এতক্ষণে হামলাকারী মুসলিমরা জেনেও গেছে হত্যাকারীরা তাদেরই মুসলিম হতে পারে! এই একটু সুযোগ পেলেই যারা আদিবাসীদের ধ্বংস করে তাদের দেশে আমাদের নিরাপত্তার কোন সুযোগ নেই। জীবনের আর কোন মায়া নেই। আমাদের স্বপ্ন ফুরিয়ে গেছে। আমরা প্রাণ আছে যতক্ষণ ততক্ষণই আছি পৃথিবীতে। একমূহুর্তও আমাদের জীবনের নিরাপদ নেই এই দেশের মুসলিমদের কাছে। আমি ক্ষমা চাইছি ওদের মানুষ বলতে পারছিনা! এমনকি নিজেকেও মানুষ ভাবতে পারছিনা।"

একজন পাহাড়ী মানুষ কতোটা বিপন্ন বোধ করলে নিজেকে এবং নিজের চারিপাশের মানুষদের মানুষ ভাবতেও দ্বিধা বোধ করে। ত্রিশ লাখ শহীদ নিজেদের সুন্দর ভবিষ্যতকে বিসর্জন দিয়েছিলো এই বালাদেশ পাওয়ার আশায়। এর আগেও বার বার পাহাড়ি ভাইবোনদের উপর নির্মম নির্যাতন নেমে এসেছে। প্রকাশ্য রাস্তায় চোর না হয়েও রোমেলকে পিটিয়ে মেরে ফেলে আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা। উস্কানি কারা দিচ্ছে সেটা সরকারকেই বের করতে হবে? পাহাড়ের শান্তি আনতেই হবে। আর কোন আগুন যেন না পোড়ায়, আর কোন প্রাণ যেন পাহাড়ে না ঝরে।