ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পর থেকে মূলত যে বিরোধের সুচনা হয়েছিলো তা প্রধান বিচারপতির দুইবারের ছুটির মধ্য দিয়ে প্রায় সমাপ্তির পথেই চলে যাচ্ছিলো। যদিও অনেক কিছুই অমীমাংসিত থেকে যাচ্ছিলো পর্দার আড়ালে বা প্রকাশ্যে। কিন্তু তাও শেষ পর্যন্ত হলো না। কারণ প্রাধান বিচারপতি এক মাসের ছুটি নিয়ে অষ্ট্রেলিয়া যাওয়ার প্রাক্কালে এক চিঠিতে আবারো কিছু কিন্তু, তবে আর এবং এর সূচনা করে গেলেন।
তিনি এক চিঠি দিয়ে গেছেন। সেখানে তিনি অনেক পুরানো কথা অবতারণা করে গেলেও সুপ্রিম কোর্টের অন্যান্য বিচারপতিরা যে তার সাথে একই বেঞ্চ বসতে অপারগতা জানিয়েছেন তা বলেন নাই। সেই সাথে তিনি ছুটির পরে ফিরে এসে কিছু বলবেন বলে উল্লেখ করেছেন। আমাদের দেশের যে কোন পর্যায়ের মানুষেরই যে আত্মসম্মান বোধ নেই তা তিনি নতুন করে উদাহরণ দিয়ে গেলেন। এবং প্রতিষ্ঠিত করে গেলেন বাংলাদেশে আত্মসম্মান বিষয়টা শুধুমাত্র কাগজে কলমে।
প্রধান বিচারপতির কিছু কিছু ক্ষেত্রে লাগামহীন কথা, অপ্রাসংগিক কথা, আলোচনা সভায় দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক নেতাদের মতো বক্তব্য রাখা থেকেই অনেকের মধ্যে সন্দেহ আসছিলো, অন্য কোন ইশারায় তিনি চলছেন কিনা। আইন অবমাননা হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও বলতে হয়, তিনি ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সরাসরি জনগণের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি শুধু জনগণের সার্বভৌমত্বকেই বাতিল করেন নাই, তিনি প্রত্যক্ষভাবে বিএনপি-জামাত এর দাবির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি এই সংসদকে অবজ্ঞা করেছেন, অপমান করেছেন এবং এই সংসদের যে কোন আইন পাশের নৈতিকতা নেই তাই বুঝাতে চেয়েছেন। শুধু তাই নয়, পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টের উদহারণ দিয়ে অন্য কিছুর ইংগিত দিয়েছেন। সরকারের সাথে প্রধান বিচারপতির বিরোধ এখানেই। এবং খুব যুক্তিসংগতভাবে সরকার মনে করতেই পারে, প্রধান বিচারপতি বিএনপি-জামাতের কোন এজেন্ডা পাশের বা ষড়যন্ত্র সফলের দায়িত্ব নিয়েছেন।
আমাদের সুশীল সমাজ (যারা বিএনপি-জামাতের এজেন্ট) এবং কিছু জামাতি-বামাতি দল সেই সঙ্গে উনার পক্ষে নেমে পড়েছেন। সংসদের সার্বভৌমত্বকে পাশ কাটিয়ে বা অস্বীকার করে যারা গণতন্ত্রের মহিমা গাইতে শুরু করেন তারা আসলে সামরিক তন্ত্রের রাবার স্টাম্প মার্কা সংসদের প্রবক্তা। তারা প্রত্যক্ষ ভাবে বাংলাদেশে সামরিক তন্ত্র এবং সামরিক গণতন্ত্র চায়। আমাদের দেশে প্রায় কয়েকজন প্রধান বিচারপতির সামরিক সরকারের প্রধান হওয়ার এবং তাদের কাজ কর্মের বৈধতা দেওয়ার ইতিহাস আছে। আমাদের ইতিহাসে সবচেয়ে নিরপেক্ষ প্রধান বিচারপতি হিসেবে যার নাম ডাক আছে তার সম্বন্ধেও রাজনৈতিক দলগুলোর নানা কথাবার্তা ছিলো এবং এখনো আছে। এ আমাদের জাতির জন্য দুর্ভাগ্য। আমরা রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ নিজেদের আত্মসম্মানবোধ জিনিসটাই বুঝে উঠতে পারলাম না। তাই চুরি করে ধরা খেলেও, এক্সিডেন্টে শত মানুষ মারা গেলেও দায়িত্ব নিয়ে নিজের পদ ছাড়ার উদহারণ আজো সৃষ্টি হলো না বাংলাদেশের ইতিহাসে। দুই একজন পদত্যাগ করলেও সে পদত্যাগ প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির চাপের কারণেই হয়েছিলো। সেও প্রায় এক ইতিহাসকালীন সময় আগে।
প্রধান বিচারপতিগণ সমাজে, রাষ্ট্র এবং সরকারে এক নিরেপেক্ষতার প্রতীক হিসেবে কাজ করেন। জনগণের মধ্যে আশা জাগিয়ে রাখেন শত অন্যায় আর অবিচারের ভীড়ে। সেই প্রধান বিচারপতিগন যখন ইচ্ছেয় অনিচ্ছেয় বিব্রতকর বক্তব্য বা মন্তব্য করেন, তখন সমাজে এর প্রভাবে বিশৃঙ্খলা তৈরী হবে এ কোন অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। এবং এমন এক সময় এইসব বক্তব্য বা মন্তব্য এসেছে যা কিনা দেশ বিরোধী চক্র গণতন্ত্রের ধুয়া তুলে দেশের ক্ষতি করার ষড়যন্ত্র লিপ্ত।
প্রধান বিচারপতি ফিরে আসবেন- তিনি বলে গেছেন তার চিঠিতে। যাবার প্রাক্কালে দেওয়া চিঠিতেও তিনি আবারো বিভিন্ন মানুষ, মন্ত্রী এবং প্রতিষ্ঠানকে দোষারোপ করে গেছেন। এবং আবার ফিরে এসে বলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছেন। কিন্তু নিজের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দোষারোপের কথা কিছুই বলেননি, যেমন বলেননি বিচারপতিদের তার সাথে একই বেঞ্চে না বসার যে সিদ্ধান্ত- সেই ব্যাপারে।