৪৭ তম স্বাধীনতা দিবসঃ পিছিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র রুখতে হবেই

কাজী রাশেদ
Published : 26 March 2018, 03:49 AM
Updated : 26 March 2018, 03:49 AM

আগামীকাল বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। আজ সেই কালো রাতের দিন যেদিন অসহায় বাংগালীর উপর পাকিস্থানি সশস্ত্র হানাদার বাহিনী ঝাপিয়ে পড়েছিলো। পাকিস্তানের জল্লাদ পেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সহ তার  জল্লাদ বাহিনীর উদ্ধেশ্য ছিলো বাঙালিকে এক রাতের হত্যাযজ্ঞে স্বাধীনতার কথা ভুলিয়ে দেবে। উদ্দেশ্য ছিলো  সব মানুষকে হত্যা করে হলেও পাকিস্তানকে রক্ষা করবে। সেই কালরাত পেরিয়ে ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার বাণী ইথারে ইথারে ভেসে চলে তৎকালীন ইপিআরের ক্যাম্পে ক্যাম্পে। যে স্বাধীনতার কথা তিনি বলেছিলেন ৭ মার্চের লাখো কোটি মানুষের সমাবেশে।

এসব কথা আমাদের সবার জানা, এই ইতিহাস আজ বাংলাদেশের সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত। যদিও একটা সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসকে মিথ্যা দিয়ে ঢেকে দিতে চেয়েছিলো এক গোষ্ঠী, যে গোষ্ঠী স্বাধীনতার পক্ষে কথা বললেও স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে নিয়ে হীণস্বার্থ চরিতার্থ করতে চেয়েছিলো। এদেশকে পেছনে নেবার  ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থেকেছিলো। আপাতদৃষ্টিতে সেই শক্তি পরাজিত হলেও এরা মিলিয়ে যায়নি, এরা হারিয়ে যায়নি, এরা সমাজের ভিতরে ঘাপটি মেরে রয়েছে। যে কোনো সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এরা ছোবল মারবে। যেমন এখনো ছোবল মেরে চলেছে নামে বেনামে, নানা অস্থিরতা তৈরী করে।

এই সকল ষড়যন্ত্রকে মোকাবেলা করেই দেশ এগোচ্ছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নও চলছে কিন্তু সামাজিক অবস্থান যেনো পিছিয়ে যাচ্ছে। একাত্তরে যখন আমরা যুদ্ধ করেছি তখন আমাদের মননে, চিন্তায় ছিলো এক  অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের, যেখানে সকল ধর্ম, বর্ণ জাতি উপজাতি সমান অধিকার নিয়ে শান্তিতে বসবাস করবে। আজ যখন পৃথিবী তথা আমাদের দেশ বিজ্ঞানের সব অত্যাশ্চর্য আবিস্কারের ফল ভোগ করছে, যখন শিক্ষায়-দীক্ষায় মানুষ এগিয়ে চলছে তখন আমাদের এই দেশ বাংলাদেশ ক্রমশ পিছিয়েই পড়ছে, সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যন্ত পিছিয়ে পড়ছে, জাতিতে-উপজাতিতে, ধর্মে ধর্মে, গোত্রে গোত্রে মানুষের হিংস্র মনোভাবে ক্রমশঃ একে অন্যের শত্রু হয়ে উঠছে। ভাই বোনকে মারছে, সন্তান বাবাকে মারছে, স্ত্রীর হাতে স্বামী, স্বামীর হাতে স্ত্রীর খুনোখুনি এখন সংবাদ পত্রের মূল সংবাদ হয়ে উঠেছে।

কারো মধ্যে স্বাভাবিক যে সৌহার্দ্য, সেই সৌহার্দ্য আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। ৭৫ পরবর্তী দেশের রাজনীতিতে অর্থকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে যে রাজনৈতিক আদর্শ আজ শুধুমাত্র কাগজ কলমের বিষয়বস্তু, রাজনীতির ময়দানে এখন আদর্শ বলে কিছু নেই।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে কমিউনিষ্টদের অবদান অবশ্যই আছে, এদেশের গুটিকয়েক বামধারা ছাড়া সবাই এদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ গ্রহন করেছিলো, দেশের ক্রান্তি লগ্নে জনগন ভোট দিক বা না দিক জনগনের  দাবি আদায় এবং গনতন্ত্র প্রতিষ্টার আন্দোলনে এই কমিউনিষ্ট দলগলোর দিকেই জনগণ তাকিয়ে থাকতো। সেই  কমিউনিষ্ট শক্তিরও আজ মাইক্রোস্কোপিক অবস্থা। গুটিকয়েক লোকের সমাবেশ বলাই ভালো। এদেশের অসাম্প্রদায়িক শক্তি বলতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকেই মানুষ বুঝতো, অথচ আজ সেই আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারেকাছেও নেই। প্রায় আওয়ামী পরিবারে আজ জামাত-শিবিরের প্রেতাত্মারা বাস করছে। ক্ষমতার রাজনীতির হিসেব নিকেশ করতে যেয়ে হেফাজত থেকে শুরু করে জামাত শিবিরকেও ছাড়  দিতে প্রস্তুত। আগে যে আওয়ামী লীগ ধর্ম ভীরুতা আর ধর্মান্ধতার পার্থক্যকে তুলে ধরতো সেই আওয়ামী  লীগের সর্ব স্তরে ধর্মান্ধ শক্তির সাথে দহরম মহরম দেখা যাচ্ছে। সমাজের বিভিন্ন স্তরে ধর্মান্ধকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের কর্মী বাহিনী নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছে বুঝে হোক আর না বুঝে হোক।

স্বাধীনতার ৪৭ বছরের মাথায় এসে স্বাধীন দেশের মানুষ আজ অসহায়, ক্ষমতায় স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব  দানকারী দল থাকার পরেও, উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকার পরেও দেশ ক্রমশঃ সাম্প্রদায়িকতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চলেছে। নারী স্বাধীনতা কথা অনেক উচ্চারিত হলেও নারীকে ঘরের মধ্যে বন্দী করার ষড়যন্ত্রে  প্রতিনিয়ত শিশু থেকে বৃদ্ধা ধর্ষিত হয়ে চলেছে। নারী নির্যাতন, খুন, যৌতুক আর বোরকার ভিতরে বন্দি করার তরিকা শুরু হয়েছে ঘরে বাহিরে সবখানে। নারী যে বোরকা পড়েও নিরাপদ থাকছে না তার প্রমান মিলছে শিশু কন্যা ধর্ষনে, বোরকায় আবৃত নারীকে ধর্ষিত হয়ে।

আমরা স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরে এসেও সামাজিক ভাবে হেয় প্রতিপন্ন হবে বলে আমাদের বীর মায়েদের কোন তালিকা করে উঠতে পারি নি। তারা নিভৃতে, নিরবে জীবনের শেষ দিনগুলো অভাবে, অনাহারে কাটাচ্ছে। গুটিকয়েক সাহসী মা নিজেদের প্রকাশ করেছিলেন কিন্তু তাদেরকেও আমরা যথাযথ মর্যাদা দিতে পারি নি। কেউ কেউ এইসব মায়ের নিয়ে নিজেদের ক্যারিয়ার গড়ার কাজে, নিজেদের সংবাদ মাধ্যম বা ইলেক্ট্রোনিক মিডিয়ার জনপ্রিয়তা বাড়ানোর কাজে লাগিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়েছেন।

কিছুদিন আগে বীর মুক্তিযোদ্ধা কাকন বিবি মারা গেলেন, তার ছবি পত্রিকায় এসেছে। মনে হয়েছে কোন দুর্ভিক্ষ পীড়িত অঞ্চলের কোনো মা মারা গেলেন অনাহারে অর্ধাহারে। আমাদের জাতির শ্রেষ্ট সন্তানদের যদি এই অবস্থা হয় তাহলে সাধারন মানুষের কী অবস্থা তা সহজেই অনুমেয়। বীর মাতা কাকন বিবির মুখায়ব যেনো বিধ্বস্ত বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি। আমদের চেতনায় সেই একাত্তর ফিরে না আসার যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে, সেই ষড়যন্ত্রের কালো আঁধার ভাংগার যুদ্ধে এবার নামতে হবে, সেই শপথে বলীয়ান হতে হবে আজকের এই ৪৭তম স্বাধীনতা দিবসে।