সাইকোসোমাটিক ডিজঅর্ডার বা সিন্ড্রোম চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক বহুল আলোচিত বিষয়। সাধারণত দীর্ঘদিন ধরে মানসিক চাপ বা অস্থিরতায় থাকলে মানুষ এসব মানসিক যন্ত্রণা থেকে দৈহিক অসুখে আক্রান্ত হয়। তখন এটা সাইকোসোমাটিক ডিজঅর্ডারে ভুগছে বলে ধরে নেওয়া হয়।
অন্যদিকে সাইকোসোমাটিক ডিজিজ হচ্ছে অনেকটা একই রকম, কিন্তু একটু ভিন্ন চরিত্রের। এখানে মানুষ বিভিন্ন ক্রনিক অসুখে ভুগতে ভুগতে সাইকিক হয়ে যায় এবং তখনই এই রোগীর মধ্যে সাইকোসোমাটিক সিন্ড্রোম পাওয়া যায়। এর অর্থ, দুটো ক্ষেত্রেই মানুষের মনের অবস্থাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
এখন মানুষ মানসিক যন্ত্রণায় কেন ভোগে তার কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, মানুষ যখন তার স্বাভাবিক পরিবেশ-পরিস্থিতিতে থাকতে চায় কিন্তু থাকতে পারে না, তখনই সে মানসিক যন্ত্রণায় থাকে এবং মানসিক চাপে পরে। এভাবে তার মানসিক চাপ শারীরিক অসুস্থতায় রূপ নেয়।
আমাদের মতো অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর পরিবেশগত কারণে অধিকাংশ লোকই স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকে। এসব দেশের জনগণের বৃহদাংশ আমাশয়, পেটের পীড়া, চুলকানী, গ্যাস্ট্রাইটিস (আমরা গ্যাস্টিকের অসুখ বলে থাকি), চুলকানী বা অনিরাপদ যৌন সম্পর্কের কারণে যৌন রোগে সারাবছর ধরে বা দীর্ঘদিন ধরে ভুগতে থাকে।
অন্যদিকে মানুষের দারিদ্রতা এসব রোগের দীর্ঘ চিকিৎসার প্রধান অন্তরায়। যার ফলে অধিকাংশ মানুষ এক পর্যায়ে এসে মানসিক রোগে ভুগতে শুরু করে। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষ তখন অপরাধ জগতে যোগ দিয়ে অপরাধ করতেও দ্বিধা করে না। মানসিকভাবে বৈকল্য এক মানুষের পক্ষে যে কোন কাজই কোন সমস্যা নয়। উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে দেখা যায়, একজন মানুষের পূর্ববর্তী কোন খারাপ রেকর্ড না থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ করেই কিছু কিছু মারাত্মক অপরাধমূলক কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত করে ফেলে। এভাবেই সমাজে অস্থিরতা তৈরি হয়।
বাংলাদেশে বর্তমানে মানুষ খুব বেশি হারে সাইকোসোমাটিক রোগে আক্রান্ত। মানসিক চাপ, অস্থিরতা, বেকারত্বের মতো যন্ত্রণায় ভুগছে। এক শ্রেণির মানুষের হঠাৎ করে বড়লোক হবার প্রক্রিয়ায় মানুষ বিভ্রান্ত ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। ন্যায়-অন্যায় বোধ সমাজে আজ অনেকটাই নির্বাসিত। মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাসবোধ, মানবিক টান বা মানুষের পাশে দাঁড়ানোর যে সহজাত স্বভাব তা আজ প্রায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
এইসব নানা অন্যায়, অবিচার, অব্যবস্থা মানুষকে বীতশ্রদ্ধ করে তুলে অপরাধী হতে সাহায্য করছে। শিক্ষা-দীক্ষায় মানুষ এগিয়ে গেলেও সমাজ আজ পুরোপুরি অন্ধকার সমাজের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ঘুষ-দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা বা বিচারহীনতার প্রবণতা মানুষকে সাইকোসোমাটিক করে তুলছে। ভিতরের ক্ষোভ, অস্থিরতা আর মনের বিদ্বেষ নানা রকমের অপরাধ করতে উৎসাহ দিচ্ছে। হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে লোপাট হয়ে গেলেও কোন বিচার নেই, শাস্তি নেই! একের পর এক একই ঘটনা ঘটে চলেছে সারা দেশে, কিন্তু কারো কোন ভ্রুক্ষেপই নেই। আর তাতেই উৎসাহী হয়ে মানুষ ছোট-খাটো অপরাধ থেকে শুরু করে ধর্ষণ-খুন-ছিনতাই-ডাকাতি করতে উঠেপরে লেগেছে।
রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য কিংবা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এমন কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না যাতে করে সমাজে শৃঙ্খলা ফিরে আসে। ক্ষমতায় যারা থাকেন এবং যারা ক্ষমতায় যাওয়ার প্রত্যাশায় বসে থাকেন তারা উভয়ই ভোটের হিসেব-নিকেশে ব্যস্ত থাকেন। সমাজের এই অস্থিরতা তাদের কোন চিন্তায় ফেলে না। তারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এবং ক্ষমতায় থাকার জন্য অস্থিরতা না কমিয়ে বরং ধর্মকে ব্যবহার করছে খুব নির্লজ্জভাবে। ধর্মীয় ব্যবসায়ীরাও এদের এই ক্ষমতার মোহকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের ইহকালের আখের গোছাচ্ছেন। নিজেদের কাজে যখন যা লাগে তার ফরমায়েস দিয়ে নিজেদের রাস্তা ঠিক রাখছেন।
আমাদের সমাজের সাইকোসোমাটিক রোগের চিকিৎসা করা আজ জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারী নির্যাতন থেকে শুরু করে সকল অপরাধের পিছনে অনেকাংশেই এই সাইকোসোমাটিক ডিসঅর্ডার দায়ি। এই সিন্ড্রোম থেকে রক্ষা পেতে দেশের আমুল পরিবর্তন দরকার। অবশ্যই সেই পরিবর্তন আসতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোর থেকে।