‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ নিষিদ্ধ করায় মাননীয় হাইকোর্টকে ধন্যবাদ

কাজী রাশেদ
Published : 1 May 2018, 00:11 AM
Updated : 1 May 2018, 00:11 AM

বাংলাদেশে একজন নারী ধর্ষিত হবার পরে তাকে দ্বিতীয়বার ধর্ষিত হতে হয় প্রচলিত চিকিৎসা এবং বিচারিক পদ্ধতিতে। সেই ব্রিটিশ আমলে প্রবর্তিত ধর্ষণ পরবর্তী যে বিচারিক পদ্ধতি তাতে করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এই জঘন্য প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই এতদিন একজন নির্যাতিত নারী ও শিশুকে বিভিন্ন স্তর পার হতে হতো, যাতে করে সেই হতভাগা নারীকে দ্বিতীয়, তৃতীয় বা পর্যায়ক্রমিকভাবে ধর্ষিত হয়ে যেতে হতো। যদি ঘটনাক্রমে কোন নারী বিবাহিত হন বা কোনক্রমে পূর্বেই তার তথাকথিত সতীচ্ছেদ ঘটে থাকে, তবে এই প্রক্রিয়ায় ধর্ষণ প্রমাণের ব্যাপারে নারীকে আরো হেনস্তার সম্মুখীন হতে হতো।

বাংলাদেশের সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বেঞ্চ থেকে বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুর এবং বিচারপতি এ কে এম সহিদুল হক অবশেষে গত ১২ই এপ্রিল ২০১৮ তারিখে ধর্ষণের প্রমাণের জন্য যে মধ্যযুগীয় 'টু ফিঙ্গার টেস্ট' বা 'দুই আঙ্গুলি পরীক্ষা' চালু ছিলো তা বাতিল বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন।

২০১৩ সালের ৯ অক্টোবর এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নারী ও শিশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষায় তথাকথিত 'দুই আঙ্গুলি পরীক্ষা' কেন আইন বহির্ভূত এবং অবৈধ ঘোষণা করা হবে না সে বিষয়ে একটি রুল দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), আইন ও সালিশ কেন্দ্র, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, নারী পক্ষ সহ দুই চিকিৎসক উক্ত রিট আবেদনটি করেন। দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর পর মাননীয় হাইকোর্ট এই জঘন্য, অপমানজনক এবং অপ্রাসঙ্গিক পরীক্ষা পদ্ধতিটি বাতিল এবং অবৈধ বলে যুগান্তকারী রায় দেন। এছাড়া মাননীয় হাইকোর্ট বিচার প্রক্রিয়ায় যে জেরা পদ্ধতি ছিলো সেখান থেকেও অপ্রাসঙ্গিক এবং যৌন হয়রানী মূলক যে সাওয়াল-জবাব প্রচলিত ছিলো তাও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।

দেশের প্রায় অধিকাংশ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা হাসপাতালে ধর্ষণ মামলার ডাক্তারি পরীক্ষা হয়ে থাকে। কিন্তু এই হাসপাতালগুলোতে মহিলা ডাক্তারের সংখ্যা একেবারেই হাতে গোনা। ইদানিং সেই সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও একসময় মহিলা ডাক্তারের সংখ্যা ছিলো একেবারেই কম। এখনও গ্রামাঞ্চলের হাসপাতাল বা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে মহিলা ডাক্তারের অপ্রতুলতা আছেই। আর সেই বাস্তবতয়ায় এতোদিন ধরে এই পরীক্ষাগুলো পুরুষ ডাক্তারদের দিয়েই করতে হয়েছে। একজন নারী বা শিশুকে তার তখনকার মানসিক অবস্থায় পুনরায় এক বিব্রতকর পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছে। এবং সেদিনের হাইকোর্টের আদেশ দেওয়া পর্যন্ত এই পদ্ধতি চালু ছিলো। এখনো সেই পদ্ধতি অনুসৃত হচ্ছে কিনা তা পরিস্কার নয়।

এই পরীক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গবেষণা হয়েছে, বিভিন্ন আপত্তিও উঠেছে। কিন্তু সঠিকভাবে এই পদ্ধতি সম্পর্কে কেউই সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরতে পারেননি। অনেকটা অজ্ঞতা, অনেকটা এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা থেকেই তা প্রকাশিত হয়নি। এ ব্যাপারে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ফাতেমা সুলতানা শুভ্রা কিছু গবেষণা করেছেন। সেই গবেষণা থেকেই এখানে কিছু তথ্য তুলে ধরছি।

"বিরাজমান এই নারীবিদ্বেষী মেডিকেল পরীক্ষণের ব্যবস্থাপনার সাথে সাথে ধর্ষণের মেডিকেল পরীক্ষার ফরমেট নিজেই একটি পুরুষালি মতাদর্শিক উৎপাদন। ব্যবহৃত 'টু ফিঙ্গার টেস্ট' ধর্ষণের সার্ভাইভার নারীর যোনিপথের ঘনত্ব পরিমাপ করে, তার হাইমেনের উপস্থিতি-অনুপস্থিতি নির্দিষ্ট করে। সাক্ষাৎকার গ্রহণকৃত চিকিৎসক জানান, পরীক্ষার সময় নারীর হাইমেনকে একটি গোলাকার ঘড়ির ফ্রেম হিসেবে দেখা হয়। ঘড়ির কাঁটার ৩ বা ১০-এর অবস্থানে যদি ধর্ষিতার হাইমেন ছেঁড়া থাকে, তবে চিকিৎসক ধরে নেন এখানে জোরাজুরি বা অসম্মতির সেক্স হয়নি। আর যদি হাইমেন নিচের দিকে অর্থাৎ ঘড়ির কাঁটার ৫ অথবা ৮-এর দিকে ছিঁড়ে, তবে চিকিৎসক এটা ঘোষণা করেন যে এই হাইমেন ছেঁড়ায় জোরারোপ করা হয়েছে। এই ভীষণ সাবজেকটিভ পরীক্ষণ পদ্ধতি কখনোই নারীর শরীরের ভিন্নতর গঠন বাস্তবতাকে নির্ণয় করবার কোনো ক্ষমতা রাখে না। বরং নারী শরীরের এই মাপজোকের সাথে নারীর যৌন সম্পর্কে অসম্মতি আছে কি নেই তা স্পষ্ট হয় না।"

"এরপরে এই রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে বিবাদীর উকিল শুরু করে আরেক ধর্ষণ প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার আসামি পক্ষের উকিল যেসব প্রশ্ন করা শুরু করতেন তাতে করে ধর্ষিতা বোনটিকে জনসম্মুখে ধর্ষণের চাইতেও হেনস্তা করা হয়। যেসব প্রশ্ন আসামি পক্ষের উকিল নির্যাতিত নারী বা শিশুকে করে থাকে তা কোন স্বাভাবিক মানুষের পক্ষেই সহ্য করা সম্ভব না, সে জায়গায় একজন নির্যাতিত নারী বা শিশুর পক্ষে তা সহ্য করা প্রায় অসম্ভব হয়।"

এই মধ্যযুগীয় মেডিক্যাল পরীক্ষা এবং কোর্টে দাঁড়িয়ে সওয়াল-জবাব করা একজন নির্যাতিতা বোনের জন্য  ছিলো এক অসহনীয় অধ্যায়। পারতপক্ষে নির্যাতিতা নারী বা শিশু বা তাদের পরিবার-পরিজন এই সব অপমানকর প্রক্রিয়ায় যেতে চাইতেন না।  মাননীয় হাইকোর্ট মধ্যযুগীয় আমলের সেই জেরাগুলোকে অবৈধ এবং বেআইনি ঘোষণা করেছেন। এতে করে ধর্ষিতা বোনকে আর লজ্জাজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে না। ধর্ষণের বিচার চাইতে এসে কোর্টের ভরা মজলিসের সামনে আবারো ধর্ষণের শিকার হতে হবে না। সময়ের দাবির সাথে একাত্ম হয়ে এক বিভীষিকাময় অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটানোর জন্য আমি মাননীয় হাইকোর্টকে তাই অভিনন্দিত করি।