প্রেম হলো স্বর্গীয় এক সুধা। আবার কারো কাছে প্রেম মানে বালতিভরা বিষ। কেউ বলবেন বেদনা, কেউ যাতনা, হতাশা, প্রলয়, মৃত্যু ইত্যাদি ইত্যাদি। হরেক রকম সংজ্ঞার ভিড়ে প্রেম কী, তার চেয়ে কী নয় –সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এটা তো ঠিক যে, প্রেম নিয়ে গবেষণায় অনেক অগ্রগতি হলেও এর সংজ্ঞা আর রকমফের নিয়ে কোনো সম্পূর্ণ রূপ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কিংবা এসব বিষয়ে মনুষ্য প্রজাতির আগ্রহের বিলুপ্তি হয়েছে এমন মনে করবার কোনো কারণ নেই। দৃশ্যমাণ পরিবর্তন বলতে যা স্পষ্ট সেটা দৃষ্টিভঙ্গির বিবর্তন, আর কিছু নয়। যতো কিছুই হোক বা না হোক, পৃথিবীতে প্রেম চলতে থাকবে, প্রেম নিয়ে গবেষণাও চলতে থাকবে—এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
কলেজে পড়ার সময় আমাদের এক বন্ধু প্রেমের এক উদ্ভট এবং সত্যি বলতে, বেশ একটু ক্রুড টাইপের প্রকরণ তৈরি করেছিলো। ওকে আমরা সবাই জিনিয়াস মানতাম। খুব ঠোঁটকাটা ছিলো। ওর কাছেই প্রথম জেনেছিলাম তিন প্রকারের প্রেমের কথা। প্রথমটি হলো এ্যকচ্যুয়্যাল প্রেম। এটাই সত্যিকারের প্রেম। বাকি দুটোর একটি হলো সেক্সুয়্যাল আর অন্যটি কমার্শিয়্যাল। যেহেতু এর চেয়ে ভালো কোনো প্রকারভেদ আমাদের জানা ছিলোনা, আমরা এটাকেই সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্নোত্তর হিসেবে জানতাম। তখন প্রযুক্তি এতোটা এগিয়ে ছিলোনা যে, গুগল করে সব পাওয়া যেতো। জানবার
পথে সমস্যা আরও ছিলো। তখন কলেজের ইংরেজি বইয়ে ব্রিটিশ কবি রবার্ট গ্রেইভ্স-এর একটা কবিতা ছিলো। নাম 'এ ফ্রস্টি নাইট'। আমাদের স্যার ছিলেন খুব চমৎকার মানুষ এবং একটু রক্ষণশীল টাইপের। এটা আরও বোঝা গেলো যেদিন তিনি ক্লাসে বললেন যে কবিতাটি তিনি পড়াবেননা। প্রমিত বাংলায় কথা বলা আমাদের প্রিয় এই ইংলিশ স্যার বললেন, "বাবারা, এটা প্রণয় সংক্রান্ত কবিতা, আর আসলে বাবা এটা পড়াতে আমার ইচ্ছে করেনা। তোমরা নিজেরা পড়ে নিও।" স্যারের অনাগ্রহ আমাদের কাছে সুড়সুড়ি হয়ে লাগলো। সেদিন কলেজ থেকে ফিরে আমি হাই ভোল্টেজ্ড আগ্রহ নিয়ে ওটা পড়ার চেষ্টা করে গেলাম, কিন্তু না। কবিতার শেষদিকের এক পঙক্তির আই লাভ ইউ ছাড়া আর বিশেষ কোনো মানেটানে বুঝতে পারলামনা; স্যারের বিব্রতবোধের কারণটাতো নয়ই। অনেক পরে আবারও ওই কবিতাটা পড়ে স্যারের বিব্রত হওয়ার কারণ অনুমান করে আমি নিজেও বিব্রত হয়েছিলাম কারণ আমার উপলব্ধি হলো, আমাদের স্যার একটু না, অনেক বেশি রক্ষণশীল ছিলেন।
পরবর্তীতে আরও অনেকের মতো আমাদেরও ধারণার অসম্পূর্ণতা কমেছে কিছু, আর তখন আরও অনেক কিছুর সাথে প্রণয় সংক্রান্ত বিশ্বাস আর ধারণাতেও নানাবিধ পরিবর্তন এসেছে। জানলাম প্লেটোনিক আর রোমান্টিক প্রেমের কোন্টা কী। আত্মিক সম্পর্ক আছে, কিন্তু শরীরবৃত্তীয় কোনো আকর্ষণ সক্রিয় নয় এমন সম্পর্কই প্লেটোনিক প্রেম। গ্রীক দার্শনিক প্লেটো এই সংজ্ঞা দিয়েছেন, আর তাই তাঁর নামানুসারে এই নাম। তবে প্লেটোর ডায়ালগ Symposium-এ সক্রেটিসের বক্তব্য আমাদেরকে প্রেমের দুইটি ধরণের সাথে পরিচিত করায়। একটি হলো 'ভালগার এরোস' (Vulgur Eros) তথা জাগতিক বা ভোগবাদী প্রেম, যেখানে শরীর সৌষ্ঠব, যৌনতা আর পণ্যাশ্রয়ী আকাংক্ষা ভালোবাসার উৎস হয়ে কাজ করে। আর অন্যটির নাম 'ডিভাইন এরোস' (Divine Eros) বা স্বর্গীয় প্রেম, যা ভোগের উর্ধ্বে এক আধ্যাত্মিক আকর্ষণ দিয়ে ব্যক্তির অন্তরকে পূর্ণ করে, আলোকিত করে। তবে সক্রেটিসের মতে, ভালগার এরোস থেকেই ধীরে ধীরে ডিভাইন এরোসের দিকে যাত্রা শুরু হয়। অবশ্য সক্রেটিস প্রেমের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য বলতে দার্শনিক সিদ্ধি অর্জনকে বুঝিয়েছেন, অর্থাৎ তিনি যে বিষয়টির উপর জোর দিয়েছেন তা হলো প্রজ্ঞাপ্রেম।
এদিকে ফ্রয়েড প্রেমকে যৌনতার সাথে আদর-সোহাগের মিথষ্ক্রিয়া হিসেবে দেখেছেন। শিশুর স্তন্যপান, আঙুল লেহন- এসবের মাধ্যমে যৌনতার সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পেয়েছেন তিনি এবং প্রেমের প্রাথমিক প্রকাশ হিসেবেও একেই বুঝিয়েছেন। এছাড়াও প্রেমের প্রকরণ বর্ণনায় ফ্রয়েড আরও তিন ধরণের অভিধা ব্যবহার করেছেন যেগুলো হলো 'লিবিডিন্যাল এনার্জি', 'এরোস', এবং 'এরোস প্লাস'। বর্তমানে ফ্রয়েডিও এসব থিউরির ব্যাপক গ্রহনযোগ্যতা থাকলেও ডারউইনের বিবর্তনবাদের 'বান্দর থিউরির' মতোই ফ্রয়েডের এই থিউরি নিয়েও যথেষ্ঠ মতানৈক্য আছে।
এবার আরেকজনের কথায় আসি। তাঁর নাম জন লী। ১৯৭৬ সালে বহুসংখ্যক প্রেমিক-প্রেমিকার অংশগ্রহণে তাঁর পরিচালিত গবেষণা থেকে ছয় ধরণের প্রেমের সংজ্ঞা তৈরি করেছেন তিনি। এগুলো হলোঃ
তবে ব্যক্তিগতভাবে রবার্ট জেফারি স্টের্নবার্গ-এর বিশ্লেষণ আমার খুব পছন্দের। বর্তমানে Cornell University-তে কর্মরত ৬৫ বছর বয়ষ্ক এই মার্কিন মনোবিজ্ঞানী তিনটি উপাদানের ভিত্তিতে প্রেমের স্বরূপ নির্ণয় করেছেন। উপাদানগুলো হলো: Intimacy(ঘনিষ্ঠতা),Passion(আবেগ), Commitment/Decision(দায়িত্ব/সিদ্ধান্ত)।এসব উপাদানের কোনটি কী পরিমান আছে, তার উপর তিত্তি করে তিনি আট ধরণের প্রেমের সংজ্ঞা নিরূপণ করেছেন, যা স্টের্নবার্গের triangular theory of love নামে পরিচিত। নিচে এগুলো সংক্ষেপে আলোচিত হলো।
শেষ কথা হলো, এইসব রকম সকমকে নির্ভূল বা অবিতর্কিত মনে করা ঠিক হবেনা। দুদিন পরেই সংজ্ঞা বদলাবে। জীবন হয়তো বদলাবেনা। আর কোনো সংজ্ঞার মাত্রায় জীবনের ব্যাখ্যা খুঁজতে যাওয়ার উষ্কানি দেয়া এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। প্রেমের ধরণ যেমনই হোক, শান্তিতে থাকাটাই হলো সবচেয়ে বেশি আরাধ্য। পৃথিবীর সকল অপ্রেমিক, প্রেমিক, প্রেমিকা, দম্পতি ও হবু দম্পতিকে স্রষ্টা যেনো শান্তিতে রাখেন। সামগ্রিক শান্তিবিধানে প্রেমের বিকল্প আর কী হতে পারে?