স্খলনের খেল তবে আঁধারেই জমে বেশ

কাজী শহীদ শওকত
Published : 13 Jan 2016, 01:54 AM
Updated : 13 Jan 2016, 01:54 AM

বিলবোর্ডে এই সাবানের বিজ্ঞাপনটি বেশ লাগে। কয়েকদিন পরপর এর চেহারা পাল্টায়, মানে সাবানের রঙ-গন্ধের সাথে সাথে বিজ্ঞাপনের দৃশ্যেও ভিন্নতা আসে। উৎপাদক তার গ্রাহকের মনের খবর জানেঃ একই জিনিষ বেশিদিন ব্যবহারে যুৎ নাই। তাই একঘেয়েমি ঠেকাতে, পণ্যের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে কৌশলী হতে হয়। অন্য পণ্যে নজর চলে যাওয়ার আগেই গ্রাহকের সামনে ভেরিয়েশন হাজির করতে হয়। ফলাফল আশানুরূপ। হরেক পণ্যের ভিড়ে গ্রাহকের চোখ আটকানো সম্ভব হয়। সম্পর্ক সুন্দরঃ তুমি খুশি, আমিও খুশি।

ভেরিয়েশনের এই ব্যাপারটা বুঝি কিন্তু স্কুল কলেজের বইয়ের চেহারায়, প্রশ্নের ধরণ ও মানবণ্টনে এতো ঘন ঘন পরিবর্তনের কী হেতু, তা কিছুতেই মাথায় আসে না। বই আর সিলেবাস যুগোপযোগি করে সাজানোর দরকার হয়। তাছাড়া প্রশ্নপত্রে, মানবণ্টনে গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন করতে হয়। এখন কি আর সেই যুগ আছে? খুবই যৌক্তিক কথা।  সেই যুগ নাই। না বোঝারও কিছু নাই।  কিন্তু তিন বছরে কয়বার যুগ চেইঞ্জ হয়?

২০১৩-তে মাধ্যমিকের সিক্স থেকে এইট অবধি নতুন সিলেবাসের ইংরেজি বই ছাড়া হলো। কিন্তু প্রশ্ন কী ধরণের হবে বইয়ে তার কোনো স্যাম্প্‌ল দেয়া হলো না। এতে করে শিক্ষক, শিক্ষার্থি কেউ প্রথমে জানতে পারেনি আসলে কেমন হবে প্রশ্ন। জানুয়ারিতে বই দেওয়া হলো আর মার্চ মাসে এনসিটিবি একটা স্যাম্পল প্রশ্ন ওয়েবে দিয়ে দায়মুক্ত হলো। এরপর সে অনুযায়ি পড়াশুনা শুরু করলো শিক্ষার্থিরা। কিছুদিন পরেই আবার বদলে দেয়া হলো প্রশ্নের ধরণ আর বলা হলো এটিই চূড়ান্ত। সিন কম্প্রিহেনশন জুড়ে দেয়া হলো, উদ্দেশ্য টেক্সট্‌ পড়ার প্রতি শিক্ষার্থিকে উদ্বুদ্ধ করা। তাতেও লাভ হলো না। বই পড়ে থাকলো। কোচিং আর গাইড থেকে পড়ার ধারাটি বজায় থাকলো। আরও মজার বিষয় হলো, মাধ্যমিক শ্রেণিতে ইংরেজির প্রায়োগিক দিককে গূরুত্ব দিয়ে স্পিকিং এবং লিসেনিং যুক্ত করা হলেও পরিক্ষায় এর জন্য কোনো নম্বর বরাদ্দ নাই। ফলে শিক্ষার্থি-শিক্ষকের সযত্ন অবহেলায় লিস্‌নিং, স্পিকিং -এর সংযোজন এই সরকারের সাফল্যের স্মারক হয়ে কাগজেই অমর হয়ে রইলো।

এদিকে ২০১৫ তে এইচএসসি'র ইংরেজি বই বেরুলো নতুন। এবারও প্রশ্ন কেমন হবে সেটি নিয়ে দেখা দিলো নানা প্রশ্ন। শুরুতে জানানো হলো একরকম। কয়েকদিন পরেই ফের নতুন মান বণ্টন, নতুন ধরণ প্রশ্নের। বই এবং প্রশ্নের মান খুব ভালো। কিন্তু কীভাবে এই বই পড়াতে হবে তার পর্যাপ্ত কোনো আয়োজন নেই। দুই-তিন দিনের প্রশিক্ষণ কোর্সে একজন শিক্ষকের নতুন সিলেবাসের ইংরেজি পড়ানোয় কী এমন পরিবর্তন এলো তা জানবার লোভ ছিলো আমার। এসব কোর্সে অংশগ্রহণকারি অনেকের সাথে কথা বলে জেনেছি, ট্রেনিং শেষে কিছু টাকা মিলেছে, আর কিছু না। সত্যিটা হলো, কিছু ব্যতিক্রম বাদে শিক্ষক ও শিক্ষার্থি উভয় পর্যায়ে ইংরেজিকে ঘিরে বিরাজমান অন্ধকার আরও জমাট হয়েছে, আরও ভয়ঙ্কর হয়েছে। আমাদের সিএলটি-ভিত্তিক ভাষা শিক্ষার আয়োজনে এটি এক নির্মম পরিহাস। শিক্ষার্থির মুখস্ত করার প্রবণতাকে রোধ করে সৃজনশীলতা উন্নয়নের যতো গালভরা বুলি সব শেষ পর্যন্ত ওই অন্ধকারে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।

তবে একটা কথা মানতেই হবে, স্কুল কলেজে মাল্টিমিডিয়ার ব্যবহার বাড়ছে। ইন্টারনেটের সাহায্যে শিক্ষকগণ তাদের কন্টেন্ট শেয়ার করতে পারছেন। এক্ষেত্রে শিক্ষক বাতায়ন সাইটটি ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। এখানে শিক্ষক সমাজের জন্য একটা দারুণ প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়েছে। বাতায়নের ব্লগে তাঁরা বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করে থাকেন। দেশের ইংরেজির একাডেমিক পড়াশুনার বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে পাঠককে একটা স্পষ্ট ধারণা দেয়ার জন্য আমি ওই ব্লগ থেকে কয়েকজন ইংরেজি শিক্ষকের লেখার স্ন্যাপশট তুলে ধরে ধরছি নিচে (সূত্রঃ  https://www.teachers.gov.bd/content )। এখানে চিহ্নিত শব্দ/বাক্যাংশগুলোর দিকে তাকালে পাঠকের যদি খুব মন খারাপ হয় তাহলে এগুলোকে 'টাইপিং মিসটেইক' ভেবে মনটাকে হালকা করে নিতে পারেন। কবি নাকি বলেছেন, "সত্য যদি বিষায় তোমার মন, মিথ্যাটারে করিও আপন।"

কোনোরূপ পাইলট প্রকল্পের ব্যবস্থা না করে, শিক্ষকগণের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের আয়োজন না করে হুটহাট বই আর প্রশ্নের ধরণ পরিবর্তনে শিক্ষার্থি তথা শিক্ষা ব্যবস্থার কী উন্নয়ন হচ্ছে তা জানা না গেলেও ধান্ধা নাকি ভালো হচ্ছে। কাগজে ধান্ধা, বইয়ের কন্টেন্ট তৈরিতে ধান্ধা, ট্রেনিং-এর নামে ধান্ধা, আর নির্দিষ্ট প্রকাশককে গাইড ব্যবসার মনোপলি উপহারের বিনিময়ে ধান্ধা। যদি তা-ই হয় তবে এতো ভেরিয়েশন বিলাসের কী হেতু তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা না। আফটার অল, ইট্‌স আ বিজনেস। তাই সম্পর্ক সুন্দরঃ তুমি খুশি, আমিও খুশি।

আমাদের শিক্ষামন্ত্রী চমৎকার মানুষ। চমৎকার আমাদের স্কুল-কলেজের ইংরেজি সিলেবাস, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, প্রশ্নপত্র, পরিক্ষা পদ্ধতি। এতো চমৎকারের মাঝে দুয়েকটা চমৎকার না-ই বা হলো। পাশের হার কি কম নাকি আমাদের? না, মোটেই না। আর কম হলেই বা কী? কবি বলেছেন, "একবার না পারিলে দেখ শতবার"। 🙂  সুতরাং বি পজিটিভ টু বি ইন বাংলাদেশ। আচ্ছা, মেট্রোরেল চালু হতে ইতো দেরি কিনো, পাঞ্জেরী?