আমাদের ব্রহ্মপুত্র–ঐশ্বর্যে অনন্য, এখনও

কাজী শহীদ শওকত
Published : 7 Feb 2016, 05:13 AM
Updated : 7 Feb 2016, 05:13 AM

ব্রহ্মপুত্র শুধু নদ নয়। আর এর জলের ধারাতেই সুন্দরের শেষ নয়। এই নদ ময়মনসিংহ নগরের মানুষের কাছে অনেক কিছুর উৎস এবং নিয়ামক। নির্মল বাতাস আর সবুজের আস্বাদ এখানে অফুরান দিন-রাত। নগরের টাউন হল থেকে এক মিনিটের অটো ডিসটেন্স। সার্কিট হাউজ মাঠটা পার হলেই চোখে পড়ে ব্রহ্মপুত্রের বুকের জলের বিশুদ্ধ টলমল।

এপারে তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা। তার পাশেই ব্রাহ্মশৈলীর চারুতলা। চিত্র প্রদর্শনী যখন হয়, তখন এখানে দেয়ালে দেয়ালে চৌকষ সব শিল্পীদের আঁকা ছবির ঢল নামে। দারুণ লাগে দেখতে। এই চারুতলা থেকে শুরু করে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে সুশোভিত গাছপালা, ফুলের বাগান, ফোয়ারা, বৈশাখি মঞ্চ, মিনি চিড়িয়াখানা, রেস্টুরেন্ট নিয়ে গড়ে উঠেছে পরিপাটি পৌর উদ্যান। এর বাইরেও বিস্তৃত হয়েছে সবুজের গাছপাতা, ছায়া আর অবসর বিনোদনের নানা আয়োজন। ওসব ভ্রাম্যমান শপটপ, চানাচুর, চটপটি, ফুচকা, ঘোড়াটোড়া, নাগরদোলা আর যা যা সবই এই নদের কারণে। ব্রহ্মপুত্র নেই মানে আর সব বায়বীয়।

এখন শীত। নদের পানি তলানিতে প্রায়। তবু সুন্দরের শেষ নেই। সকালে এই নদে এবং আশপাশে অনেক পাখির দেখা মেলে। আলো ফুটবার একটু পরেই পাখিসব দিগ্বিদিক ফুরুৎ-ফুরুৎ উড়ে যায়। ততক্ষণে মানুষের আনাগোনা বাড়তে থাকে। এঁরা প্রাতঃভ্রমণের পোকা। রোগ নিরাময় কিংবা প্রতিরোধের দাওয়াই এখানে ফ্রিতে পাওয়া যায়।

বিকেলের দিকে পার্কে বেশ লোকজন হয়। ছুটির দিনগুলোতে ভিড় লেগে যায়। সুদৃশ্য টাইলের বেঞ্চি পাতা আছে অনেক। ওদিকে বাগানের পাশে ঘন ঘাসের চওড়া আসন; তবুও নদের ঠিক কিনারে, স্ল্যাবের গায়ে বসে কিংবা দাঁড়িয়ে থাকাতে যেনো অন্য এক মজা। বাতাসটা সোজা গায়ে এসে লাগে। ভালো লাগে। নদের বুকে নৌকা চলে। প্রতি বছর এখানে নৌকাবাইচ হয়। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ দল বেঁধে দেখতে আসে দুর্লভ এই প্রতিযোগ।

ওই পারের বিস্তীর্ণ চরে ফসলের ক্ষেত, স্থানীয়দের বসতি এপার থেকেই অসাধারণ লাগে। ওপারে গেলে তো কথাই নেই। ওখানে অন্য এক সুন্দরের বিস্তার। একেক ঋতুতে একের দৃশ্যের আয়োজনে নতুন করে সেজে উঠে এই নদ। শরতে এখন এপারে তেমন কাশফুল হয়না। কিন্তু ওপারে কাশের সাদায় থৈ-থৈ করে। বসন্তে এখানে অনেক ফুল ফুটে। দিনের বেলা কৃষ্ণচূড়ার লাল চোখ ভাসিয়ে দেয়। সন্ধ্যার পর কী কী সব ফুলের ঘ্রাণ পাওয়া যায়। ছাতিম ফুলের মাতাল করা ঘ্রাণের মতো।

তখন রোদের দীর্ঘ দিন। রমজানের মাঝামাঝি। আকাশ ভরা আগুন। তামাম দুনিয়া যেনো দোজখ হয়ে জ্বলছে। টেম্পারেচার ছত্রিশ-সাঁইত্রিশ। দুপুর না গড়াতেই তৃষ্ণায় জান যায় যায়। খুব সিরিয়াস ধার্মিক না হলে এসময় পানি পান না করে উপায় নেই। সেদিন চারটায় কাজ শেষ। সিদ্ধান্ত নিয়েই বেরিয়েছি, পৌর পার্কের কোনো রেস্টুরেন্ট থেকে কিছু জলযোগ করে তারপর নদের ধারে বসে বসে বাতাস খাবো। ইফতারের ঠিক আগে বাসায় ফিরবো।

ঘামতে ঘামতে নদের সামনে এসে নামতে গিয়েই দেখি এ কী! এ তো ঠাণ্ডা বাতাসের স্বর্গ! অনেকেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, গা এলিয়ে নদের ধারে বেঞ্চিতে, কংক্রিটের উপর  শুয়ে-বসে আছে। জলে তখন চকচকে ছলাৎ-ছলাৎ। আমিও বসলাম একটা গাছের ছায়ায়, নদমুখো হয়ে। বাতাস খেতে খেতে জলখাবারের কথা মনে নেই। মনে যখন হলো তখন ইফতারের সময় হয়ে গেছে। এমনি করে কতো জনের জীবনে এই হ্যান্ডসাম নদ কতো সব সুন্দর পুরে দিচ্ছে, অসুন্দরকে শুষে নিয়ে ভাসিয়ে দিচ্ছে দূর-দূরান্তে—তার খবর কে রেখেছে!

  হরেক দেশের হরেক নদ-নদীর সুন্দরে চোখ পড়ে। চোখ জুড়ায়। বুক জুড়ায় না। মন ভরে না। আপন লাগে না। এই ব্রহ্মপুত্রের ধার ঘেঁষে দাঁড়ালে পৃথিবীর অন্যত্র নদ-নদীর যতো সৌন্দর্য আছে , সব ত্যানা-ত্যানা হয়ে যায়। এই সুন্দর এক অপার্থিব প্রাচুর্যের ভাণ্ডার নিয়ে জেগে থাকে প্রাণে প্রাণে। ব্রহ্মপুত্র আমাদের সকলের।

…………………………..

ছবিঃ লেখক

https://www.facebook.com/kazishahidshawkat