ভালোবাসার এ কোন কুসুম ফুটিলো ফাগুনে?

কাজী শহীদ শওকত
Published : 13 Feb 2016, 03:51 AM
Updated : 13 Feb 2016, 03:51 AM

কাননে কুসুম ফুটিয়াছে। কোথাও কোথাও কোকিলও ডাকিয়াছে। মানে বসন্ত আসিয়াছে। আর বসন্ত আসিলে ভ্যালেন্টাইন্‌'স ডে-ও আসে। টাইমিং চমৎকার। বর্ণমালার সিকোয়েন্স-ও খাপে খাপ। 'ব'-তে বসন্ত, 'ভ'-তে ভ্যালেন্টাইন। অদ্য হইতে আগামি দুই-তিনদিন ফুলের বাজার চড়া থাকিবে, ইহা জানা কথা। অন্য সব দিনে যেমন তেমন, এই বিশেষ দিবসগুলো অনেকের কাছেই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

তরুণ-তরুণীগণ উপহার আদান-প্রদান করিবে, পার্কে, রেস্টুরেন্টে যাইবে, এইটা-ওইটা খাইবে আর কলকলাইবে— খুবই স্বাভাবিক।

 আর এই রকম বিশেষ দিবসে ফুলের মূল্য বাড়িলেও ক্রেতাগণের আপত্তি আছে বলিয়া মনে হয় না। প্রণয় সস্তা নহে, তবে গোলাপ কেনো হইবে? অনেকেই তো বিশ্বাস করেন, এই দিবসটির সূচনাই হইয়াছে চকোলেট, কার্ড, জুয়েলারি ইত্যাদি বিক্রির ধান্ধা মাথায় রাখিয়া (ভিডিও দেখুন)। কিন্তু প্রণয় দিবস লইয়া মুরুব্বিগণের অভিযোগের লিস্টি বহুত লম্বা। আরেকটা লক্ষণীয় ব্যাপার হইলো, বসন্ত উৎসব সকলের হইলেও ভ্যালেন্টাইন্‌স ডে কিন্তু সকলের নহে। মাদার্স ডে যেমন এতিমের জন্য যন্ত্রণার, তেমনি ভ্যালেন্টাইন্‌স ডে-ও অনেকের কাছে ভীষণ মন খারাপের দিন। একজনের আছে, আরেকজনের কেউ নাই—এমন ভাবনা একদিকে যেমন যন্ত্রণা বাড়াইয়া দেয়, তেমনি এই দিনকে কেন্দ্র করিয়া অনেকের অনুসন্ধান প্রক্রিয়া আরও বেগবান হয় ।

ফেব্রুয়ারি আসিলেই যেমন বাংলা ভাষার স্বীকৃতি, গুরূত্ব কিংবা বিকৃতি লইয়া ব্যাপক কপচানো শুরু হয়, তেমনি ভ্যালেন্টাইন'স ডে-র উদ্‌যাপন লইয়াও প্রচুর কথাবার্তা হয় যেমন এই মূহুর্তে হইতেছে। এই দিবসের উপকার সংক্রান্ত যতো বাত-চিত শুনা যায় তাহার তুলনায় ইহার নেতিবাচক প্রভাবের কথাই বোধ করি বেশি উচ্চকিত। অনেকেই তো শফিক রেহমান সাহেবের গুষ্টি উদ্ধারে ব্যস্ত হইয়া পড়েন। এই ভদ্রলোকই নাকি ভ্যালেন্টাইন নামক বিজাতীয় সংস্কৃতির ভাইরাস এই দেশের তরুণ সমাজের মধ্যে ইঞ্জেকশন দিয়া ঢুকাইয়া দিয়াছেন। তিনিই নাকি যতো নষ্টের গোড়া। আবার এই দিবস পালনের চর্চা বন্ধ করিবার মহৎ তৎপরতাও বেশ দৃশ্যমাণ।

ভ্যানেন্টাইন'স ডে-তে অনেক অভিভাবকের, বিশেষ করিয়া কন্যার পিতামাতাদিগের মধ্যে, আঁৎকা অতিশয় সচেতনতা উদ্ভূত হইতে দেখা যায়।

 তাঁহারা এই দিনে সন্তানের গতিবিধি সিসি টিভি ক্যামেরার মতো অনুসরণ করিয়া থাকেন। উদ্দেশ্য পরিস্কারঃ যে কোনো মূল্যে এই সব অপসংস্কৃতির প্রভাব এবং তৎসংশ্লিষ্ট সকল আকাম-কুকাম (তাহাদের ভাষায়) ঠেকানো।  অতি সতর্ক কেউ কেউ নাকি স্বীয় সন্তানদের উপর বাড়ির  বাহির হইবার ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করিয়া থাকেন। ইহার ফলে কাহারো সযত্নে খরিদকৃত গোলাপ হয়তো শুষ্ক হইয়া ধূলায় গড়ায়, কিংবা কাহারও পরিকল্পনা বাতাসে মিলায়, কিন্তু তাই বলিয়া প্রেমও কি তেমন নাকি? না, ইহা কোনো ক্লোরিন-ফ্লোরিন-আয়োডিনটিন নহে যে, বাতাসে মিলাইয়া যাইবে। প্রেমের মড়াই যেইখানে ডুবে না নদীর জলে, সেইখানে জীবন্ত মানুষের প্রেম উদ্বায়ী হয় কী কৌশলে? ভালো তো দূরে থাক, এই সকল আকস্মিক শাসনের বাড়াবাড়ি প্রায়শই আরও খুব মন্দ পরিণতি ডাকিয়া আনে।

একটি ঘটনা বলিবো। সত্য ঘটনা। ইঁহারা স্বামী-স্ত্রী দুইজনই বেজায় ব্যস্ত। তবে সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য যাহা যাহা করিবার তাহার কোনো কিছুতেই চেষ্টার ত্রুটি নাই। ইঁহাদের একমাত্র কন্যা তখন একাদশ শ্রেণিতে পড়ে। কন্যার কলেজ হইতে একদিন ফোন আসিলো।

কলেজের অধ্যক্ষ জরুরি তলব করিয়াছেন। গুরুতর বিষয়। কী বিষয়? ইঁহাদের কন্যা কলেজ ড্রেস পরিহিত অবস্থায় পার্কে ভিন্ন কলেজের এক ছাত্রের সাথে একান্তে সময় কাটাইতেছিলো। কেহ একজন ইহা দেখিয়া অধ্যক্ষকে ফোনে বিষয়টি জানাইয়াছিলো আর তৎক্ষণাত কলেজের কাজের কথা বলিয়া ছাত্রীটিকে কলেজে ডাকিয়া আনিয়া দরদি কর্তৃপক্ষ পিতা-মাতার কাছে সোপর্দ করিয়াছিলো। এরপর বেশ কিছুদিন মেয়েটির কলেজে আসা বন্ধ ছিলো। পরে আবার সব স্বাভাবিক হইয়া গিয়াছিলো; অন্ততঃ তাহার বাবা-মা তেমনটি ভাবিয়াই তাহাকে আবারও ক্লাসে যোগদানের অনুমতি দিয়াছিলেন। কেহ জানিতে পারে নাই, শাসনের বাড়াবাড়িতে কী প্রতিক্রিয়া তাহার হইয়াছিলো। তবে কিছুটা আন্দাজ করা গিয়াছিলো, যেইদিন সহসা জানা গেলো, কলেজ হইতে ইঁহাদের সেই আদরের কন্যাটি আর বাড়ি ফিরে নাই। পরে যখন তাহার খোঁজ মিলিলো, ততক্ষণে শাস্ত্রানুযায়ী সে আরেকজনের স্ত্রী। উপরন্তু, মেয়েটির অভিযোগ ছিলো, তাহার বাবা-মা-ই তাকে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করিয়াছে। বিবাহ করা কোনো অপরাধ নহে,  তবে এইরূপ অতি আবেগিক সিদ্ধান্তে অনিশ্চিত যাত্রায় বিলীন হোক সম্ভাবনা, এমনটি আমরা নিশ্চয়ই কেহই চাইনা।

আসলে ব্যাপার হইলো Testosterone, Vasopressin কিংবা Oxytocin হরমোনের প্রভাবকে এড়ানো মানুষের পক্ষে সম্ভব যেহেতু নহে,

মানুষ একজন আরেকজনের প্রেমে পড়িবে ইহাতে চমকিয়া যাইবার কিছু নাই। যৌক্তিকভাবে বলিতে গেলে, ভ্যালেন্টাইন্‌স ডে-তে একজন আরেকজনকে ফুল দিলো, পাশাপাশি হাঁটিলো, আর ইহাতে সংস্কৃতির প্লাস্টার খসিয়া গেলো তেমনটি ভাবিতে পারিতেছি না। কারণ আমরাই সেই জাতি যাহারা ঘরে বসিয়া রগরগে হিন্দি/ইংরেজি সিনেমা দেখি সকলে মিলিয়া, বিদেশি গায়িকা-নায়িকা আনিয়া নাচাই আমাদের সাংস্কৃতিক আয়োজনে— যেইখানে আমাদের অনেক গুণী শিল্পী নিরবে ঝরিয়া পড়েন অবহেলায়। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতালগুলোকে আমরা বানাইয়া তুলিয়াছি ঠকের দোকানঘর। হাতের টাকা বেশ কমিয়া না গেলে দেশি পণ্যে মন সায় দেয় না আমাদেরই তো। চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের তাণ্ডবে হাজারও মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হইলেও শুধু রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে তাহাদের বিচার করা সম্ভব হয় না যেই দেশে, ভয়ঙ্কর দুর্নীতিবাজ হিসাবে পরিচিতদেরকেও যেই দেশের মানুষ দিনে-রাতে চুমা দেয় আর ফুলের মালা দিয়া বরণ করে, সেই দেশে ভ্যালেন্টাইন্‌স ডে-তে প্রেমিক প্রেমিকাকে ফুল দিলে, চুম্বন করিলে, পার্কে হাত ধরাধরি করিয়া হাঁটিলে আশ্চর্য হইবার মতো কিছু তো থাকিবার কথা নহে।

এক্ষণে আপনি যদি ভাবিয়া থাকেন, আমি প্রকাশ্যে চুম্বনের অধিকারের পক্ষে ওকালতি করিতেছি, ভুল হইবে তবে। আমার কথা চুমাচুমি নিয়া না। আমার কথা হইলো, চৌদ্দই ফেব্রুয়ারিকে ভালোবাসা দিবস হিসাবে উদ্‌যাপনের বিরূদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিয়া যাহারা ভাবিতেছেন, এই বুঝি দূর হইলো শয়তান, শুরু হইলো শুদ্ধ সংস্কৃতির মুক্তির দিন—তাহারা যদি আবেগের সঙ্গে কিঞ্চিৎ বিচক্ষণতার ব্যবহারে মনযোগি না হইতে পারেন তবে আখেরে বিভেদই বাড়িবে; সাংস্কৃতিক সুরক্ষা বলেন আর নৈতিক স্খলনের চিকিৎসাই বলেন–কোনোটাই হইবে না।

স্খলন ঠেকাইতে হইলে যাইতে হইবে আরও গোড়াতে। যৌনতাসহ জীবনাচারের বিবিধ বিষয়কে ট্যাবু হিসেবে ট্যাগিং না করিয়া পারিবারিক আলোচনায় স্থান দিতে হইবে। বাবা-মা তাঁহাদের সন্তানের ভিতর যথা সময়ে প্রয়োজনীয় সচেতনতা গড়িয়া তুলিয়াছেন কি না, সন্তান বাবা-মায়ের নিকট হইতে কতোটুকু কোয়ালিটি টাইম পাইতেছে, সন্তানের উপর আদরের নামে অতিশয় প্রশ্রয় কিংবা শাসনের নামে নির্মম অত্যাচার হইতেছে কি না, সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে নৈতিকতার চর্চা কোন্‌ পর্যায়ে বিরাজমান ইত্যাদি সব প্রশ্নের জবাব খুঁজিতে হইবে আগে। ভ্যালেন্টাইন্‌'স ডে তো নাম শুধু। এই দিনে যাহা যাহা হয় বলিয়া বলা হয়, তাহা অন্য দিনে হয় না–এই রকম তো নহে।

হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্‌স ডে!

সংযুক্ত ছবিগুলি অন্তর্জাল হইতে সংগৃহীত

https://web.facebook.com/kazishahidshawkat