জাকারবার্গের ষড়ব্যঞ্জন বাটন সমাচার

কাজী শহীদ শওকত
Published : 27 Feb 2016, 07:34 AM
Updated : 27 Feb 2016, 07:34 AM

ফেইসবুকে ডিসলাইক বাটন বসানোর যে জল্পনা-কল্পনা এতোদিন ছিলো তার অবসান হয়েছে। দেরিতে হলেও ডিসলাইক-এর পরিকল্পনা থকে সরে এসে অবশেষে জাকারবার্গ আগের লাইকের সাথে আরও পাঁচটি রিয়েকশন বাটন যোগ করেছে। আপাত দৃষ্টিতে ভালোই মনে হচ্ছে। ডিসলাইকের চেয়ে এই ছয় অনুভূতির সমন্বয় (লাইক, লাভ, হাহা, ওয়াও, স্যাড আর এ্যংরি) অনেক ভালো হয়েছে। এতোদিন ত্রিভূজ, ষড়ভূজ, ষড়রিপুর সাথে আমাদের ছিলো প্রকৃতির দান ষড়ঋতু। এখন যুক্ত হলো এই ষড়ব্যঞ্জন অনুভূতির ফেইসবুকিয় বিলাস। ভালো লাগলে এক নম্বরটা, ভালোবাসলে দুই নম্বরটা। হাসি-কান্না, উচ্ছ্বাস, রাগ সবই হবে বাটনে বাটনে। যাক্‌, ডিজিটাল দেশ, ডিজিটাল ভালোবাসা। একশো পার্সেন্ট অকৃত্রিম ডিজিটাল ভালোবাসা। কারণ আগে তো প্রেম হতো চোখে চোখে, মুখে মুখে, কিংবা মনে মনে। আর এখন থেকে প্রেম হবে ক্লিকে ক্লিকে। একদম ডল্‌বি ডিজিটাল লাভ। জাকারবার্গের জয় হোক।

ব্যাটাকে ডিসলাইক না লাগানোর জন্য আমিই বলেছিলাম।  গত বছর এই ডিসলাইক বাটন ভরে দেয়ার আকামটা করার জন্য যখন চিন্তা-ভাবনা চলছে সিলিকন ভ্যালিতে, বেশ অবাক লেগেছিলো। এতো বড়ো সাইটের সিইও-এর মাথায় এরকম একটা বেক্কইল্যা কামের পোকা কে ঢুকালো? কোনো ষড়যন্ত্র হচ্ছে না তো? তার সাথে কথা ক'বো সে উপায়ও নেই। ফোনে পাওয়া মুশকিল। বিজি মানুষ। আবার এদিকে আমার মাথায় চিন্তার বলক—জাকারের মাথায় পোকার আছর হইলে কামে নামতে দেরি হয় না; কখন আবার ফট করে ডিসলাইক গেঁড়ে দেয় ফেইসবুকে! তো তাড়াতাড়ি করে সেপ্টেম্বর মাসেই ওকে ইনবক্স করে দিলাম। বললাম, 'তুমি তো মনে করতেছো মানুষের ডিসলাইকের খায়েস মিটাইবা, কিন্তু এই ডিসলাইক যে ফেইসবুকের সর্বনাশ ডেকে আনতেছে সেটা একবারও ভাবলা না? তোমারে যদি কেউ ডিসলাইক মারে, তোমার আরাম লাগবে? আর ডিসলাইক মারা নিয়া যখন ইউজারদের মধ্যে গুঁতাগুঁতি, হাতাহাতি, মারামারি হবে তখন কে ঠেকাবে, তোমার বাপে?' আরও অনেক যুক্তিটুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে শেষে বললাম যেনো এ কাজ ভুলেও না করতে যায়, বরং অন্য কোনো পরিবর্তন আনা হোক যাতে কারও অন্তরে দাগা না লাগে।

এরপর তো চার-পাঁচ মাস চলে গেল প্রায়। হুট করে সেদিন ফেইসবুকে এই বাটন ব্যঞ্জন দেখে ব্যাপক মনোরঞ্জন পেলাম । ভাবলাম, যাক, পাগলাটা শেষ পর্যন্ত আমার কথা রেখেছে। এই কয়েক মাসে ওর সাথে আর কোনো যোগাযোগও হয়নি। লাইকের এই সংস্করণ দেখে ভাবলাম, ওকে একটা ধন্যবাদ দেয়া দরকার। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে এতো দেরি হয়েছে বলেই হয়তো শরমে ও এতোদিন আর যোগাযোগ করেনি। ছেলেটা আবার ছোটো থেকেই একটু লাজুক স্বভাবের। কী আর করা, আমি নিজেই আবার ইনবক্স করতে গেলাম।  গিয়ে মনটা এতো খারাপ হলো এজ ইফ কেউ এক বালতি পটাসিয়াম সায়ানাইড ভরে দিয়েছে। ব্যাটা কত্ত বড়ো ফাজিল! ওই আগের ম্যাসেজটাই এখনও সে পড়ে দেখেনি।এইটা কিছু হইলো! তাইতো বলি সেপ্টেম্বরে টেক্সট করলাম, সিদ্ধান্ত নিতে এতো দেরি কেনো। এই যে এই কয়েক মাস নাদানটা শুধু শুধু চিন্তা করে গেলো এই সাধারণ একটা ব্যাপার নিয়ে, এতে লস কি আমার হয়েছে? ফ্রি-তে পরামর্শ দিয়েছি তো, যুৎ লাগেনি।

সমস্যা তো কেবল শুরু। এই যে, Like -এ ক্লিক করতে গেলে Love -এ ক্লিক পড়ে যাচ্ছে, মানে বলতে চাচ্ছি যে,এখন ভালো লাগাতে গেলে যে ভালোবাসা হয়ে যাচ্ছে, এটাকে আপনি ইতিবাচক বলবেন? আচ্ছা ছাড়ুন, এটা না হয় দুয়েকশ লাইক মারার পর ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু বাকিটা? বাকিটা হলো, রিয়েকশন অপশনের সীমাবদ্ধতা।  মানুষ কি ফেইসবুক পোস্টে খালি এই ছয় অনুভূতিই প্রকাশ করে ক্ষান্ত হবে? আরেকটা কথা, বাটনগুলোর দিকে একটু তাকান। দেখলেন তো, ইকুইটির কী চরম অভাব! 'দুঃখে কাইন্দাল্‌ছি' বোঝাতে যদি বাটনের চোখের সাথে অশ্রু থাকতে পারে তাহলে রাগের বাটনে মুখের মধ্যে দাঁত কেনো নেই? চরম রাগে কেউ যদি 'তোরে চাবায়া খাইয়াম' বুঝাতে চায় তাহলে এই বাটনে চলবে?

এবার আর আমি আগ বাড়িয়ে কিছু বলবো না। আমার কোনো সমস্যা নেই। আমার ওরকম চাবাইন্যা রাগ উঠে না। কিন্তু সবাই তো আমার মতো না। ওহ্‌, আরেক কথা তো বলাই হয়নি। এই ছয় বাটনের সিরিয়ালটা খেয়াল করেছেন? Like, Love, Haa, Wow, Sad, Angry। মানে হলো, ভালোলাগা থেকে ভালোবাসাবাসি। এরপর হাসাহাসি। মানে বিয়ের পর হাসিখুশি দাম্পত্যের প্রাথমিক ধাপ। এরপর ওয়াও ওয়াও—মানে বাচ্চাকাচ্চা, মানে সংসারে সন্তান আগমনজনিত সারপ্রাইজ। এরপর কী? এরপর দুঃখ আর রাগ। চালাকি করে পরেরটা দেয়নি, খেয়াল করেছেন? ছেলেটার বুদ্ধি একেবারে খারাপ না। ব্রেক-আপ বাটনটা ইচ্ছে করে এড়িয়ে গেছে। তবে যা-ই হোক, এবার আমি কিন্তু আর আগ বাড়িয়ে কিছু বলছি না।