মচ্ছব মৌসুম আগডুম বাগডুম

কাজী শহীদ শওকত
Published : 2 March 2016, 01:40 PM
Updated : 2 March 2016, 01:40 PM

যদিও গায়ের জোরে এখনও এ দেশে অনেক কিছুই চলছে, তবে রিক্সাগুলোর ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটতে দেখা যাচ্ছে। প্রযুক্তি এখন রিক্সাকে দ্রুতগতির যানে পরিণত করেছে। প্যাডেল-ঠেলা রিক্সায় করে আগে রাস্তা ফাঁকা থাকলেও যেখানে যেতে পাক্কা বিশ মিনিট লাগতো, সেখানে এই ব্যাটারি চালিত রিক্সায় যেতে এখন সাত-আট মিনিট লাগে বড়োজোর। প্রথম যেদিন দেখলাম তিন চাকার রিক্সাটা হর্ন বাজিয়ে ভীষণ বেগে ছুটে যাচ্ছে, খুব অবাক লেগেছে। আমারও অনেকের মতো সামান্যতেই অবাক হওয়ার ব্যারাম আছে। এখন রিক্সা ডাকার আগে রিক্সার তলা দেখার নতুন অভ্যাস পেয়ে বসেছে। পছন্দের উৎস এখন তলে তলে, যেখানে ব্যাটারির বাক্স থাকে। আর কোনোদিন বাধ্য হয়ে বিলুপ্তপ্রায় ম্যানুয়াল রিক্সায় উঠলে পরে এর ধীর গতিতে অস্বস্তি হয়। মন চায় রিক্সাওয়ালাকে বলি, "ভাই, আরেকটু জোরে চালানো যায় না?" এতোদিন ছয় সিটের অটো রিক্সাগুলোর দাপটে সনাতন এসব রিক্সার মালিক-শ্রমিকদের খারাপ দিন যাচ্ছিলো। এখন ব্যাটারি পাওয়ারের সংযোগে এগুলোর দিন ফিরেছে। কয়েকদিন পরে গতরখাটা রিক্সার অস্তিত্ব থাকবে না বলেই মনে হচ্ছে।

গরু দিয়ে হালচাষ যেমন উঠে গেলো যান্ত্রিক লাঙলের আগমনে। ভালোই হয়েছে। রোদের রাস্তায় একজন মানুষ তার নিজের শরীর দিয়ে আরেকটি মানুষকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, সভ্য মানুষের জীবনে বহুদিন ধরে স্বাভাবিক হয়ে বিরাজমান এই দৃশ্যের ইতি ঘটতে যাচ্ছে। আগে বৃদ্ধ রিক্সওয়ালা যারা আমাদের সিম্প্যাথির নিষ্ঠুর শিকার হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেকার বসে থাকতেন তাদের জন্যও সুসংবাদ, কারণ এখন আমাদের মায়ার জৌলুস কমিয়ে দিয়েছে নতুন সংস্করণের এসব ক্লাসিক রিক্সা। একই সাথে রিক্সাগুলো এনএমভি (নন মটোরাইজ্‌ড ভিহিক্‌ল) নামের দারিদ্র্য ঘুচিয়ে জাতে উঠলো। আহা! এমনি করে আমাদের মনের দারিদ্র্য আর অন্যায় প্রবণতাগুলোও যদি ঘুচে যেতো একদিন!

সেদিন বাজারে এক সব্জির দোকানে দেখি বড়োসড়ো জটলা। সবজি বিক্রেতা ওজনে কারচুপি করে ধরা খেয়েছে। আর যে যেমন পারছে গালি দিয়ে তাকে সভ্য করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আরেকদিনের কথা মনে পড়ছে। কোনো এক ঈদের

আগের ঘটনা। মার্কেটে মানুষের মাথা আর মাথা। হঠাৎ ভিড়ের ভেতর চিৎকারের শব্দ। ঠেলেঠুলে কাছে গিয়ে দেখি নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে ছেলেটার। বাঁ চোখটা ফুলে আছে। চিৎকার করে বলছে, "আমারে ছাইরা দ্যান, আর জীবনেও চুরি করতাম না।" তখনও ওকে কিল, ঘুসি, থাপ্পর দেয়ার জন্য মুখিয়ে আছে অনেকেই। ভাগ্যিস, ঠেকানোর দায় নিয়ে কয়েকজন ছিলো ওখানে। ছেলেটার বয়স দশ কি বারো। এক ভদ্র মহিলার ব্যাগ থেকে মোবাইল চুরির ট্রাই করেছিলো। ব্যর্থ হওয়াতে তার এই হাল। আচ্ছা, ঘুষখোর কোনো পাবলিক সার্ভেন্টকে একদিন সুযোগ বুঝে রাস্তায় ফেলে এমন গণ ধোলাই দিতে গেলে হাত কি কেঁপে উঠবে জনতার? সেদিন স্বপ্নে দেখলাম, দুজন লোক স্যুটেড-বুটেড-পারফিউম্‌ড-নাদুস-নুদুস কিন্তু নাক-মুখ ত্যাবড়ানো এক অজ্ঞান বা মৃত লোককে রাস্তা থেকে পৌরসভার ময়লার গাড়িতে তুলছে, আর চারপাশে জনতার উল্লাস। এসব কিসের আলামত? এতো আগডুম-বাগডুম স্বপ্ন আগে কখনও দেখিনি।

ঘুমের মধ্যে কী দেখলাম সেটা মোটেই গূরুত্বপূর্ণ নয়। তবে বাস্তবে দেখা ওই দৌড়ের দৃশ্যটি এখনও ভুলতে পারিনি; সম্ভবত ইউটিউবে দেখেছিলাম। কোনো এক টিভির ক্রাইম রিপোর্ট। আড়াল থেকে ট্রাফিক পুলিসের চাঁদাবাজির ভিডিও চিত্র ধারণ করছিলো টিভি ক্যামেরাম্যান। পরে কাছে গিয়ে চাঁদাবাজটাকে রিপোর্টার যখন এ ব্যাপারে প্রশ্ন করতে চাইলো, তখনই শুরু হলো সিনেম্যাটিক এ্যকশন। সরকারি পোশাক পরা এই রাজপথ সেবকের(!) সে কী দৌড়! এই প্রথম দেখলাম, ক্যামেরাতঙ্ক আর জলাতঙ্কে কী চমৎকার মিল! পুলিস ভাই দৌড়ায়, বেরসিক সাংবাদিক ভাইও পেছন পেছন দৌড়ায়। কিন্তু পারলে তো! যাদের হাত লম্বা, তাদের ঠ্যাং-ও লম্বা হয়। বায়োলজিক্যাল ফ্যাক্ট।

তবে আমার মনে হয় দুর্নীতির চিত্র দেখাতে গিয়ে সাংবাদিকগণ পুলিশকেই টার্গেট করছে বেশি বেশি। এতে কৌশল ও সময় দুটোরই সাশ্রয় হয়, সেটা বুঝি; কিন্তু প্রোপোর্শনাল ইকুইলিব্রিয়াম, মানে আনুপাতিক ভারসাম্যের ব্যাপারটি উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে খুব। ফলে পুলিশকে ভিলেইনের দায় দিয়ে বাকিরা মচ্ছব করার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে বেশ। আবার সর্ষেতেও নাকি প্রচুর ভূতের আছর হচ্ছে আজকাল।  'ঝাপসা স্টুডিও'র ক্যামেরা আর ক্যামেরাম্যান যতোই দামী হোক, স্টুডিও'র সাইনবোর্ড দেখে এমন বিশ্বাস জন্মানো সহজ নয় যে, এখানে ভালো ছবি হবে।

এক বড়ো ভাই বড়ো এক কোম্পানিতে কাজ করেন। সারাদিন এ শহর সে শহর ঘুরতে হয় তাকে। আমাকে একবার জিজ্ঞেস করলেন এখানে ভালো হোটেল কোনটি। আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না, নিজের আত্নীয়ের বাসায় উঠেছেন

যিনি, তিনি কেনো হোটেলের খোঁজ করছেন। তখনও বেশ বেওকুফ ছিলাম বলেই তাকে প্রশ্নটা করেছিলাম। তাকে হোটেলে থাকার বিল জমা দিতে হবে অফিসে। সুতরাং কোনো একটা হোটেলের ব্ল্যাঙ্ক রসিদ লাগবে তার। এমনি বহু রকমের রসিদের কারবার তার নাকি প্রতিদিনই হয়ে থাকে। এটাই নাকি সিস্টেম। তার যুক্তি হলো, অফিস তো এই খরচটা তার জন্য বরাদ্দ রেখেছে। এখন তিনি যদি আত্মীয়ের বাসায় থেকে সেটা সেইভ করতে পারেন তাতে ক্ষতি কী? কথায় যুক্তি আছে। এই যুক্তির কথা শুনে আমার ক্লাস সেভেনের একটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা মনে পড়ে গিয়েছিলো। স্কুল থেকে বাসায় আসার পথে এক মসজিদের দান বাক্সে চোখ আটকে গিয়েছিলো আমার কারণ বিশ টাকার চকচকে নোটখানা বাক্সের ছিদ্রপথ অতিক্রম করে ভেতরে না যেতে পেরে আমার দিকে তাকিয়েছিলো। বিশ টাকা তখনও 'মাত্র' নয় আমার কাছে। আশপাশে দেখে ফেলার মতো আর কোনো চোখ নেই। আমি ওটা নিয়েওছিলাম। কিন্তু হাতটা এমন কাঁপছিলো! শেষে টাকাটা বাক্সের ভেতরে পুরে দিয়ে কেটে পড়েছি। এমন কতো যে হাতের কম্পন ধীরে ধীরে সুযোগে সুযোগে থেমে গেছে, তা এই সুযোগ(!) বঞ্চিত আমি অধম কী করে বুঝবো?

তবে সবাই যে স্রোতে ভেসে যায় না, তা বিশ্বাস করি। এ প্রসঙ্গে এক ব্যাংকার বন্ধুর কষ্টের আখ্যানটা বলতে হয়। সিনিয়র অফিসার এই বন্ধুটির তখন বেশ টানাপোড়েন যাচ্ছে। নতুন সংসারে খরচের বেশ চাপ ছিলো তার। তখনও সেলারি তার এতোটা

বাড়েনি যে অনায়াসে সামলে নেয়া যাবে সব। এমনি ক্রান্তিকালে অফিসে সুযোগ উদয় হলো। ব্যাংকের পুরনো ক্লায়েন্ট এসেছেন একজন যার সাথে ওর এই প্রথম দেখা। ব্যাবসায়ী এই ক্লায়েন্টের একটা লোন দরকার আর তার জন্য সামান্য ডকুম্যান্ট সুবিধা চাই, এবং এক রকম জোর করেই ওর হাতে বেশ কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে গেলেন। বলে গেলেন বাকিটা কাজ শেষে; ঠিক যেমনটি আগে ওর চেয়ারে বসা অফিসারকে দিতেন। জীবনে প্রথম পাওয়া ঘুষের ওই টাকা বাড়িতে এনে প্রথমে ভালোই লেগেছে ওর। কিন্তু কী যে হলো, সারারাত আর ঘুম নেই। শুধু বিবেকের দংশন। সাহিত্যে পড়াশুনা করা মানুষ হলেই এমন হবে তেমন তো নয়। তাছাড়া ও ধর্মকর্মও খুব একটা করতো না বলেই জানতাম। তবু কেনো যেনো ওই টাকাটা ওর নেয়া হয়নি।  পরদিন অফিসে এসে ওই ক্লায়েন্টকে ডেকে নিজের অক্ষমতার কথা স্বীকার করে টাকাটা ও ফেরত দিয়েছিলো। আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া ভাগ্যে না থাকলে এমনই হয়। ও নিশ্চয়ই গাছ নয়, পাখি হতে চায়।

একত্রিশে ডিসেম্বর আর পয়লা জানুয়ারিতে এতো মানুষ নিশ্চয়ই পৃথিবীর আর কোনো দেশে জন্মে না। সত্যি না হোক কাগজে কলমে তো আছে। কী বিচিত্র মানসিকতা! একটু হিসেবের সুবিধার জন্য তারিখের ভিন্নতা এনে কিংবা সন্তানের ভবিষ্যৎ বিবেচনায় (!?) অরিজিনাল জন্মদিন থেকে দুই-এক বছর বাড়িয়ে দিয়ে আমরাই সর্ব প্রথম মিথ্যার বীজটা এই যে রোপন করে দিচ্ছি প্রজন্মের ভেতর— তার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে আমাদের তো আরও খুশি হওয়ার কথা, তাই না? যে দেশে শিশুর শিক্ষা শুরু হয় বাবা-মা কর্তৃক প্রদত্ত মিথ্যা জন্ম সন/তারিখ দিয়ে, অর্থাৎ যে দেশের বেশিরভাগ সচেতন বাবা-মায়ের সন্তানদের জন্মের ঠিক নেই, সে দেশে অবৈধ সরকার আরও একশো বছর থাকলেই কী যায় আসে কার? উন্নয়ন কী থেমে আছে?

প্রিয় দাদা ও দিদিরা, এখন বসন্ত কাল। প্রকৃতি কী সুন্দর করে সাজে দেখেছেন? বিকেলের বাতাস যেনো স্বর্গের অনুদান। সময় করে প্রিয়জনকে নিয়ে ব্যাটারি পাওয়ার্ড রিক্সায় বসে (কার হলে তো কথাই নেই) প্রকৃতি দর্শনে বেরিয়ে পড়ুন সবুজ কোথাও। দৃষ্টি দিয়ে নিয়মিত সবুজ সেবন করুন। কবি বলেছেন, 'দেখে নিও প্রতিদিন লতা-পাতা-গাছ, বদলাতে হবে না চশমার কাচ'। 🙂 😛 আর উন্নয়নের এই রিমঝিম ধারাতে যদি চায় মন হারাতে, তবে চলুন বায়োমেট্রিক পয়েন্টে গিয়ে আঙুলের ছাপ দিয়ে আসি। দিয়ে থাকলে আবার দেয়ার সুবিধা আছে। আসুন আমাদের সিমগুলো সুরক্ষিত রাখি। সুস্থ সিম, সুস্থ জীবন।

ছবিঃ অন্তর্জাল থেকে নেয়া