গাঁয়ের গন্ধ গায়ে যদি থাকেই তবে ক্ষতি কী?

কাজী শহীদ শওকত
Published : 14 April 2016, 03:10 AM
Updated : 14 April 2016, 03:10 AM

বিশেষ দিবস এলেই তার সূচনা, তাৎপর্য, বৈধতা, নৈতিকতা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনার সুযোগ হয়। বাংলা বছরের সূচনাতেও তার ব্যত্যয় দেখি না। উৎসবের আয়োজনের পাশাপাশি এসব নিয়ে মতামত বিশ্লেষণ চলতে থাকে। ইলিশ নিয়ে নানান কথা চলছে। কেউ ইলিশ লুটে নিচ্ছেন, কেউ ইলিশ কিনে নিচ্ছেন, কেউ কিনবেন না বলে জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী তো সাফ বলে দিয়েছেন নববর্ষে তাঁর ম্যানুতে ইলিশ এবার থাকছে না। তবে তাতে করে বাজারে ইলিশের ব্যবসা ধপাস করে পড়ে যাবে তেমন আশংকা নেই।

একটু আগেভাগে ইলিশটা কিনে রাখলে এতো দামে কেনার দরকার হয় না। কালও খুব ভিড় গেলো দোকানে দোকানে। অনেকেই আগেই কিনে রেখেছেন যার যার যা কিছু কেনার। তবু এই ভিড়ের ঠ্যালা কারও কারও সইতেই হয়। এরই মাঝে আবার ভূমিকম্পের ঝাঁকি। আতঙ্ক পিছু ছাড়লো না। উৎসবে ভয়ের টপিক খুব বিচ্ছিরি হয়।

ভয় নয়, পান্তার কথা বলি। পান্তার সাথে লবণ, পেঁয়াজ আর সবুজ মরিচ। গরম ভাতও রান্না হতো; তবু সকালে ওঠে প্রথমে ওই পান্তার স্বাদ বাদ যায়নি। ইলিশটা পান্তায় আমাদের যায়নি 🙁 এখনও যায় না। গতবারও ট্রাই করেছি, ভাল্লাগেনি। এখনও কারও সাথে রেস্টুরেন্টে খেতে বসলে আমার মরিচ খাওয়া দেখে তার অস্বস্তি হয়। ঝালপ্রেম যায় না। বাসায় বিরোধীরা আছে বলে চেঁপার স্বাদে কিছুটা ভাটা। ইলিশের ভাজা, আর তার মাথা তরকারিতে ভালো লাগে। ইলিশের মাথার দুপাশে দুটো ছোটোমতো চিলতে থাকে। খুব মজা লাগে। মাথা খাওয়ার কথা মনে হতেই ওই কী যেনো নাম মেয়েটার …মারা গেলো যে সেদিন…ওর থেঁতলানো মাথার ছবি ভেসে ওঠলো। এদিকে দৈনিকে কাল দেখি একটা আকাম করে রেখেছে। ওই রাজন ছেলেটার এত্তোবড়ো একটি ছবি ছেপে দিয়েছে। মরে যাওয়ার আগে নাকি ছেলেটা খুব পানি খেতে চেয়েছিলো। পত্রিকাওয়ালারা কি মানুষ না নাকি? এখন পান্তা খেতে গিয়ে যদি ওর কথা মনে পড়ে যায়, মজাটা কেঁচে যাবে না? মিসিং দ্য ডিলিট বাটন।

ছোটবেলাটাকেও খুব মিস করা হয়। ঠাণ্ডা জলের পুকুর…চারপাশে তার ছায়াগাছের সারি–নারকেল আর অর্জুন ছাড়া আরও দুয়েক জাতের কী কী যেনো ছিলো, নাম মনে নেই। গরমে গনগনে দুপুরের আকাশটা কালো হতে শুরু করলে আমাদের মন খুশির কাশফুল হয়ে নেচে উঠতো বৈশাখে আষাঢ়ে। থমথমে আকাশের আরশিতে আসন্ন বৃষ্টির ইশারায় প্রেম ছিলো…আর তাতে আমরা আসক্ত ছিলাম। পানির নিচ থেকে কান পেতে শোনা বৃষ্টির পতনশব্দে যে অর্কেস্ট্রা আমাদের মুগ্ধতায় মিশে গিয়েছিলো, তাকে দূরে সরানোর কার আছে হিম্মত? আমরা ওই পুকুরেই প্রথম ভাসতে শিখেছি, ডুবতে শিখেছি। বিজলীর চমকে আকাশের সাপখেলা আমরা সিনেমাতে নয়, গুঁড়ি-বৃষ্টিতে ভেজা ক্ষেতের গ্যালারিতে শুয়ে-বসে-দাঁড়িয়ে দেখেছি; তুমুল বজ্রপাতে আমাদের হার্টবিটে ছন্দপতন হয়নি কখনও, কারণ আমরা তখন ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ওই শব্দ পরবর্তী নৈঃশব্দের অপেক্ষা করেছি গল্পের বাকি অংশটা বলবো বলে, শুনবো বলে।

জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতির পাঠ্যপুস্তক ছোটবেলায় পাইনি বলে বুক পানিতে গা এলিয়ে মূত্র-বিসর্জনের সময় নুনুর সাথে জলের তলার কৌণিক দূরত্ব কতো থাকে সেটি জানা সম্ভব হয়নি তখনও। তবে নল-খাগড়াকে কতো ব্যাসার্ধ্য নিয়ে কাটলে বেলুন-বাঁশিতে সুর ঠিকঠাক হবে সেটি বুঝতাম। কালবোশেখি ঝড়ের বেগ কতোটা তীব্র হলে হাতের ছাতা উল্টে গিয়ে সেটি ডাঁটাশুদ্ধ শাপলার আকার ধারণ করে- তা আমরা স্কুল থেকে ফেরার পথে হাতে-ছাতায় শিখে নিয়েছি। অরিগ্যামি'র প্রাথমিক পাঠ ছিলো আমাদের নৌকা, এবং ঘুড্ডির নিবিষ্ট নির্মাণে। গোল্লাছুটে, দাড়িয়াবান্ধায় চুপটি করে বসে আছে আমাদের সুগ্রন্থিত সম্পর্কের সুন্দর। ধানের গন্ধ, খড়ের গন্ধ, বৃষ্টিভেজা মাটির গন্ধ; পান্তাভাতে রসের জারণ, পেঁয়াজ এবং মরিচ লবণ –এসব আমাদের ভাব-ধরানো ভিমরতি নয়, চর্চিত সুন্দর আচার এবং অভ্যাস। আমরা ভাসতে ভাসতে, ডুবতে ডুবতে, ছন্দে গন্ধে, আলো-ছায়ার সুন্দরে বেড়ে ওঠা প্রাণোচ্ছ্বল শৈশবের স্মৃতিধন্য জীব।

ওইসব দিনের পর বহু দিনরাত আরও গেছে ভেসে শীতে বসন্তে। দৃশ্যপট বদলেছে দিনে দিনে। এগিয়েছে বহুদূর জীবন জগৎ। তবুও কিছুটা রয়ে গেছে সঞ্চয়ে আগের মতোই। নতুন অভ্যাসের চর্চায় এখনও খসে যেতে বাকি কতিপয় পুরাতন ঘাস-পাতা সবুজের রঙ।

কৃত্রিম কৃচ্ছতার ছুঁতোয়, কিংবা বৈশাখি শুভেচ্ছা'র কার্ডের রঙ, পাঞ্জাবি-শাড়ি আর পান্তাভাতের দামের অংকে বিমল আনন্দ হয় কারও কারও। তাই বলে আবাহনী-মোহামেডান খেলতে হবে কেনো? এমনকি দরিদ্র শৈশবের কষ্ট ঢাকতে জং ধরা জীবনে আনন্দের নামে এক্সট্রাভ্যাগেন্সকে বুকে-জড়িয়ে বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতার ছদ্মাবরণে যারা পূঁজিবাদ-মৈথুন করেন তাদেরকেও স্যালুট জানাই আজ। আমরা সবাই বাঙালিই তো।

"অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে

নির্মল করো, উজ্জ্বল করো, সুন্দর করো হে

জাগ্রত করো, উদ্যত করো, নির্ভয় করো হে।"

শুভ নববর্ষ।